ওহেনরীর ছোট গল্প

ও. হেনরী’র ছোট গল্প: শেষ পাতাটি

অনুবাদ ছোট গল্প সাহিত্য

শেষ পাতাটি
(The Last Leaf)

মূল লেখক : ও. হেনরী

ভাষান্তর: শাহ্জাহান মানিক

ওয়াশিংটন স্কোয়ারের পশ্চিমে ছোট এই জেলা শহরে রাস্তাগুলোর রূপ অনেকটা বন্য আর ছোট-ছোট ভাগে সেগুলো বিভক্ত, যাদের “প্লেস” বলে ডাকা হয়। এই “প্লেসগুলো” অদ্ভুত সব বাঁক আর মোড়ে ভরপুর। কোন কোন রাস্তা তার নিজের উপর দিয়ে কখনও বা একাধিকবার কেটে বেরিয়ে গেছে। একদা এক চিত্রশিল্পী এই রাস্তার সম্ভাবনা ও মূল্যকে আবিষ্কার করেন। যেমন ধরুন: রঙ, কাগজ আর ক্যানভাসের দাম আদায় করার জন্যে কোন বিল আদায়কারী হয়তো একই রাস্তায় কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করল, তারপর হঠাৎ দেখবে সে একই জায়গায় ফিরে এসেছে, ফলশ্রুতিতে এক সেন্টও তার একাউন্টে আর জমা হয়ে ওঠে না।
তাই, অদ্ভুত প্রাচীন এই গ্রীনউইচ ভিলেজে দ্রুতই শিল্প জগতের লোকেরা উত্তরে জানালাওয়ালা কম ভাড়ার অষ্টাদশ শতকের পুরানো বাড়ি আর চিলেকোঠার খোঁজে হানা দিতে শুরু করে। তারপর সিক্সথ এ্যভিনিউ থেকে কয়েকটা টিনের মগ আর ক্ষয়ে যাওয়া দু’ একটি পাত্র আমদানি করে তারা এখানে “কলোনি” গড়ে তোলে। এখানেই জীর্ণ ও পুরনো একটি তেতলা বাড়ির মাথায় স্যু আর জনসির স্টুডিও। “জনসি” হচ্ছে জোয়ানার প্রচলিত নাম। ওদের একজন এসেছে মেইন থেকে আর অন্যজন ক্যালিফোর্নিয়া থেকে। এইটথ স্ট্রিটে “ডেলমনিকোস” নামক একটা হোটেলের টেবিলে খেতে গিয়ে তাদের আলাপ হবার পর ওরা খুঁজে পায় যে শিল্প, চিকোরি সালাদ এবং রুচিতে তাদের এতো মিল যে যার ফলাফলে তাদের এই যৌথ স্টুডিওর সৃষ্টি।
ওটা ছিল মে মাস, কিন্তু নভেম্বরের মতোই শীতল। অদেখা এক আগন্তুকের মতো, ডাক্তাররা যাকে নিউমোনিয়া বলেন, কলোনিতে হানা দিয়ে এখানে ওখানে কয়েক জনকে তার হিম শীতল আঙ্গুল দিয়ে স্পর্শ করে বসল। পূর্ব দিকে এই ঘাতক তার নির্মম আক্রমণ চালালেও প্লেসগুলোর শ্যাওলা ধরা সংকীর্ণ গোলক-ধাঁধাঁয় তার পদক্ষেপ ছিল ধীর।
নারী ত্রাতা বীর-প্রৌঢ়া বলে আপনি যাকে ডাকবেন জনাব নিউমোনিয়া তাদের মধ্যে পড়ে না।
ক্যালিফোর্নিয়ার পশ্চিমা বাতাসে রক্ত তরল হয়ে যাওয়া এক ক্ষীণকায় মহিলা একটি ক্রুদ্ধ হিংস্র মূর্খ দানবের কদাচিৎ শিকার হবার যোগ্যতা রাখে। তবুও জনসিনকে সে আক্রমণ করে বসল। অসুখে পড়ে সে তার বিছানায় শুয়ে ছোট জানালাটার শার্শি দিয়ে পাশের বাড়ির ফাঁকা দেয়ালটার দিকে তাকিয়ে, প্রায় নিশ্চল দেহে নিজের রঙ লোহার খাটিয়ায় পড়ে রইল।
এক সকালে লম্বা পাকা ভ্রু-ওয়ালা ব্যস্ত ডাক্তার স্যু-কে হলঘরে ডেকে পাঠান। থার্মোমিটারের পারদ ঝাড়তে ঝাড়তে তিনি বললেন- “বাঁচবার আশা খুব কম। একমাত্র ভরসা রোগীর যদি বাঁচার তীব্র আকাংখা থাকে। সেটা থাকলে রোগী অনেক সময় পুরো চিকিৎসা বিদ্যেকে বোকা বানিয়ে দিতে পারে। কিন্তু তোমার এই বান্ধবী যেন পণ করেছে যে সে আর ভালো হবে না। ওর মনে কোন আশা-আকাংখা আছে কি?”
“ওর, ওর ইচ্ছে ও একদিন নেপলস-এর উপসাগর আঁকবে,” স্যু জবাবে বলল।
“আঁকার কথা রাখো! দ্বিতীয়বার চিন্তা করার মতো কোনো কিছু কি ওর মনে আছে- মানে কোনো পুরুষকে কি ও ভালোবেসেছে?”
“পুরুষ মানুষ?” স্যু-র কন্ঠস্বর তীক্ষ্ণ হয়ে উঠে। “পুরুষমানুষ কি এতো গুরুত্বপূর্ণ- না ডাক্তার, সে-রকম কোনো ঘটনার কথা আমি শুনিনি।”
“তাহলে আশা বড় কম,” ডাক্তার বললেন। “ওষুধের মাধ্যমে যা-কিছু করার তা আমি করবো। তবে আমার কোন রোগী যখন তার শেষ যাত্রার অনুষ্ঠানে কতো লোক থাকবে তার হিসেব করতে শুরু করবে তখন আমি ওষুধের রোগ সারানোর ক্ষমতাকে শতকরা পঞ্চাশ ভাগ বাদ দিয়ে দেই। যদি তুমি ওর কাছ থেকে একটা কথা শুধু জিজ্ঞেস করে আদায় করতে পারো যে এবারের শীতে নতুন কি স্টাইল বেরিয়েছে- তাহলে আমি তোমাকে কথা দিতে পারি ওর বাঁচার আশা পাঁচের মধ্যে এক হয়ে যাবে যেখানে এখন আশা দশের মধ্যে এক।”
ডাক্তার চলে যাবার পর স্যু ওদের কাজের ঘরে গিয়ে কিছুক্ষণ কান্নাকাটি করল। তারপর তার ছবি আঁকবার বোর্ডটা হতে নিয়ে শিস দিতে দিতে জনসির ঘরে ঢুকে।
জনসি চুপ করে জানালার দিকে মুখ করে শুয়ে ছিল। স্যুর মনে হল জনসি বোধহয় ঘুমুচ্ছে- তাই শিস দেওয়া বন্ধ করে।
স্যু আপন মনে বোর্ডটা সাজিয়ে একটা সাময়িক পত্রিকার গল্পের জন্যে ছবি আঁকতে শুরু করে। যারা নতুন লেখক তারা যেমন সাহিত্যে নাম করবার জন্যে সাময়িক পত্রিকায় লিখে হাত পাকায়, তেমনি তরুণ শিল্পীরাও সাময়িক পত্রিকায় ছবি এঁকে হাত পাকায়।
স্যু যখন ছবি আঁকছিল, তখন হঠাৎ একটা অদ্ভুত শব্দ কানে আসতেই সে জনসির বিছানার পাশে গেল।
জনসির চোখ খোলা ছিল। সে বাইরের দিকে চেয়ে কী যেন গুণছিল।
জনসি গুণছিল- ‘বার’, তারপর ‘এগার’, তারপর ‘দশ’, তারপর ‘নয়’, তারপর ‘আট’, তারপর ‘সাত’।
উৎকন্ঠিত হয়ে স্যু-ও জানালার বাইরে তাকালো। সেখানে গোনার মতো কি আছে? শুধু একটি নীরব, নিস্তব্ধ উঠোন আর বিশ ফুট দূরে একটা ইটের বাড়ির ফাঁকা দেয়ালটাই তো চোখে পড়ে। একটা পুরানো আইভিলতা ইটের দেওয়ালটার আধখানা বেয়ে উঠেছে- যার শিকড়টা শুকিয়ে গেছে। শরতের ঠান্ডা হাওয়ার পরশে তার পাতাগুলো খসে গেছে- শুধু কঙ্কালসর্বস্ব ডাঁটা প্রশাখাগুলো ইটের দেওয়ালে আঁকড়ে রয়েছে কোনো রকমে।
“কী দেখছ?” স্যু জিজ্ঞেস করল।
“ছটা,” জনসি প্রায় ফিস ফিস করে বলে উঠল। “খুব তাড়াতাড়িউ খসে পড়ছে ওগুলো। তিন দিন আগেও একশোটার মতো পাতা ছিল। গুনতে আমার মাথা ধরে যেত। কিন্তু এখন গোনা খুব সোজা হয়ে গেছে। ওই যে আরো একটা খসে গেল- এখন রইল মাত্র পাঁচটি পাতা।”
“পাঁচটা, কি সেগুলো? তোমার স্যুডিকে বলো।”
“পাতার কথা বলছি। ঐ যে আইভিলতা গাছটা দেখছ, ওর পাতা। যখন শেষ পাতাটা খসে যাবে তখন আমিও চলে যাব। তিন দিন হলো আমি জানতে পেরেছি। ডাক্তার কি তোমাকে সে কথা বলেনি?”
“ওহ, এ ধরনের বাজে কথা আমি কখনও শোনিনি,” আহত স্বরে স্যু বলল। “আর তোমার ভালো হওয়ার সঙ্গে পাতা-ঝরার কী সম্পর্ক? বুঝেছি ঐ গাছটাকে তোমার খুব ভালো লাগতো তো তাই বলছো, দুষ্টু মেয়ে। ওসব কথা ভাববে না তুমি। কেন, আজ সকালেই ডাক্তার তোমার ভাল হয়ে ওঠার আশার কথা বলছিল- তুমি শীঘ্রই সেরে উঠবে, কি যেন সে বলছিল- বলছিল দশে এক। এখন এই ঝোলটুকু একটু খেয়ে নাও, আর তোমার স্যুডিকে আবার আঁকতে দাও যাতে আমি সম্পাদকের কাছে গিয়ে ছবিটা বিক্রি করে কিছু টাকা আনতে পারি যা দিয়ে তোমার জন্যে পোর্ট ওয়াইন আর আমার নিজের জন্যে খাবারও কিনে আনবো।”
“আমার জন্যে তোমাকে আর মদ আনতে হবে না,” জনসি বলল জানালার বাইরে দৃষ্ঠি রেখে। “ঐ যে আরো একটা পাতা খসল। আমি আর ঝোল খাব না। আর চারটে পাতা রইল। আঁধার ঘনিয়ে আসার আগে শেষ পাতার খসে পড়াটা আমি দেখতে চাই। তারপর আমিও চলে যাবো।”
“জনসি, লক্ষীটি,” ওর দিকে ঝুঁকে স্যু বলল, “আমাকে কি তুমি কথা দিবে যে তুমি চোখ বুজে থাকবে এবং আমার কাজটা শেষ না হওয়া পর্যন্ত জানালা দিয়ে বাইরে তাকাবে না? কালকের মধ্যেই আঁকাটা আমাকে শেষ করতে হবে। আমার আলো দরকার হবে নইলে আমি জানালাটা বন্ধ করে দিতাম।”
“ও-ঘরে গিয়ে কি তুমি আঁকতে পারো না?” শীতল কন্ঠে জনসি বলল।
“আমি এখানে তোমার পাশে বসে থাকতে চাই,” স্যু বলল। “তাছাড়া আমি চাই না তুমি ঐ হতচ্ছাড়া আইভি-পাতার দিকে তাকিয়ে থাকো।”
“তোমার আঁকা শেষ হলেই আমাকে বলবে,” চোখ বুজে চুপ করে শুয়ে থেকে জনসি বলল। “আমি শেষ পাতাটার খসে যাওয়া দেখতে চাই। অপেক্ষা করতে করতে আমি ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। আর ভাবতে পারছি না। আমি এখন সবকিছুর মায়া কাটিয়ে ঐ অসহায় ক্লান্ত পাতাগুলোর মতো ভেসে ভেসে নিচে হারিয়ে যেতে চাই।”
“তুমি একটু ঘুমোনোর চেষ্টা কর,” স্যু বলল। “বুড়ো সন্ন্যাসীর মডেল হতে আমি বেরম্যানকে ডেকে আনতে যাচ্ছি। এক মিনিটও লাগবে না। আমি ফিরে না আসা পর্যন্ত তুমি একটুকুও নড়বার চেষ্টা করবে না।”
বুড়ো বেরম্যান একজন চিত্রকর। সে তাদের বাড়ির নীচতলায় থাকে। বয়েস তার ষাট পেরিয়ে গেছে। মুখে মাইকেল অ্যাঞ্জেলের মতো লাম্ব ঢেউ খেলানো দাড়ি। বেরম্যান একজন ব্যর্থ শিল্পী। চল্লিশ বছর ধরে তুলি চালিয়েও কোনো নাম যশ কামাতে পারেনি। তার চিরকালের ইচ্ছে একবার হলেও সে একটা মাস্টারপিস আঁকবে- কিন্তু তা কখনো শুরু করা হয়ে ওঠেনি। অনেক বছর ধরে কেবল বিজ্ঞাপনের ছবি আঁকা ছাড়া আর কিছুই আঁকেনি। নতুন শিল্পীরা যারা পেশাদার মডেল নিয়ে কাজ করার সামর্থ রাখেনা মাঝে মাঝে তাদের মডেল হিসেবে কাজ করেও সে সামান্য কিছু আয় করে। খুব মদ খায় সে। আর সে যে একদিন শ্রেষ্ঠ একটি ছবি আঁকবে সে কথাটা এখনও বলে। এ ছাড়া সে একজন ভয়ানক প্রকৃতির লোক- তার কাছে হৃদয়বৃত্তির কোনো মূল্য নেই। তবে উপরতলার এই দু’জন মেয়ে শিল্পীকে সে একটু নেক-নজরে দেখে- নিজেকে তাদের নজরদার বলে সে ভাবে।
বেরম্যানের ঘরে গিয়ে স্যু দেখল ভেতরে মিটিমিটি আলো জ্বলছে আর মদের উৎকট গন্ধ বের হচ্ছে বেরম্যানের শরীর থেকে। আর ঘরে ছবি আঁকবার সেই বোর্ডটা তখনো তেমনি ফাঁকা। গত পঁচিশ বছর ধরে একটা আঁচড়ও কাটেনি তাতে সে। বেরম্যানকে জনসির বিষয়টা খুলে বললে সে- কেমন করে জনসি শুকনো নিজে পাতার মতো খসে পড়ে যাবার ভয় করছে।
লাল টকটকে চোখ নিয়ে এ ধরণের বোকার মতো কথা শুনে বেরম্যান উপহাস করে উঠল।
“দূর,”বেরম্যান চিৎকার করে বলল- “আইভি গাছ থেকে পাতা খসে যাবার সঙ্গে মরে যাবার কথা কেউ কল্পনা করতে পারে! যত্তোতসব উদ্ভট ভাবনা। আমি জীবনেও এরকম কথা কখনো শুনিনি। না, আমি তোমার ঐ বুড়ো সন্ন্যাসীর মডেল হবো না। এ ধরণের বোকার মতো ভাবনা তুমি তোমার বান্ধবীর মাথায় ঢুকতে দিলে কেন? আহা, বেচারী মিস জনসি!”
“জনসি খুব রোগা আর দুর্বল,” জনসি বলল, “আর ঐ জ্বরের জন্যেই যতো সব অদ্ভুত ভাবনা ওর মাথায় ভর করছে। ঠিক আছে, মি. বেরম্যান, তুমি যদি আমার মডেল না হও তো আর কী করা। তবে আমার ধারণা তুমি বড্ড বুড়ো হয়ে গেছো- থুত্থুরে বুড়ো!”
“একেবারে মেয়ে মানুষের মতো কথা বললে,” বেরম্যান বলল। “কে বলল আমি মডেল হবো না? তুমি যাও। আমি তোমার ওখানে আসছি। আমি তো আধঘন্টা ধরে বলে আসছি আমি মডেল হব- মিস জনসির মতো ভালো মেয়ে এখানে অসুখ হয়ে পড়ে থাকবে, এটা ভালো কথা নয়। একদিন দেখো আমি একটা মাস্টারপিস আঁকব- তখন আমরা সবাই এই জায়গা ছেড়ে চলে যাবো। বুঝলে কিছু?”
তারা দু’জনে যখন উপরের তলায় গেল তখন জনসি ঘুমোচ্ছে। স্যু জানালার পর্দাটা নামিয়ে দিয়ে বেরম্যানকে নিয়ে পাশের ঘরে চলে যায়। সেখান থেকে দু’জনে ভয়ে ভয়ে জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে আইভি লতাটার দিকে তাকাল। তারপর কোন কথা না বলে দু’জনে দু’জনের দিকে এক মুহুর্ত তাকিয়ে রইল। বৃষ্টি হচ্ছে- বৃষ্টির সঙ্গে বরফও পড়ছে। বেরম্যান তার নীল শার্টটা পরে মডেল হয়ে বসল।
এক ঘন্টা ঘুমিয়ে পরদিন সকালে যখন স্যু উঠল তখন সে দেখল জনসি বন্ধ জানালাটার দিকে চেয়ে আছে।
“জানালাটা খুলে দাও, আমি দেখবো,” ফিস ফিসিয়ে জনসি বলল।
উদ্বিগ্ন ভাব নিয়ে জানালা খুলে দিল স্যু।
কিন্তু আশ্চর্য, সারা রাত ধরে অতো বৃষ্টি আর ঝড়ের পরও ইটের দেয়ালের গায়ে সেই আইভিলতার গাছে তখনও একটা পাতা জেগে রয়েছে। ওটাই শেষ পাতা। গোড়াটা এখনও সবুজ রয়েছে, যদিও ধারগুলো হলদে হয়ে গেছে। পাতাটা মাটির উপরের প্রায় বিশ ফুট উঁচুতে ডালে ঝুলে রয়েছে শক্ত হয়ে।
“ওটাই শেষ পাতা,” জনসি বলল। “আমি ভেবেছিলাম, রাত্রে বৃষ্টিতে ওটা নিশ্চিত ঝরে যাবে। বাতাসের শব্দ আমার কানে এসেছে। আজকে ঠিক ঝরে পড়বে- আমিও তখন ঠিক সেই সময় মরে যাবো।”
“শোন, শোন,” স্যু নিজের মুখটা বালিশের কাছে নিয়ে এসে বলল “জনসি, নিজের কথা তুমি না ভেবে আমার কথাটা একবার ভাব। তুমি চলে গেলে আমি তখন কী করে থাকবো, বলতো?”
কিন্তু জনসি কোন জবাব দিল না। এই পৃথিবীতে তার মতো নি:সঙ্গ কেউ নেই, আর রহস্যময় সেই দূর যাত্রায় সে প্রস্তুত হচ্ছে। যেন তার সঙ্গে এ-পৃথিবীর সমস্ত সম্পর্ক ক্রমশ: ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে।
দিন গড়িয়ে চলল, এমনকি গোধূলির স্বল্পালোকেও দেখা গেল পাতাটা তখনও দেয়ালের গায়ে আটকে রয়েছে। রাত আসার সাথে সাথে আবার উত্তরে বাতাস বইতে শুরু করল। বৃষ্টির ঝাপটা এসে আঘাত হানতে শুরু করল জানালায়।
সকালের আলো ফুটতেই জনসি জেদ ধরলে পর্দাটা তুলে দিতে।
আইভিলতার পাতাটা তখনও সেখানে রয়েছে।
জনসি অনেকক্ষণ সেদিকে চেয়ে শুয়ে রইল। তারপর স্যু-কে ডাকল। স্যু তখন জনসির জন্যে মুরগীর সুপ রান্না করছিল।
“আমি খুব খারাপ মেয়ে, স্যুডি,” জনসি বলল। “আমি যে খারাপ তা দেখাতে শেষ পাতাটাও এখনও সেখানে রয়ে গেছে। মরতে চাওয়াটা পাপ। আমি আর মরতে চাই না স্যুডি। তুমি আমার জন্যে ঝোলটা নিয়ে এসো, আর সেই সাথে দুধের সাথে একটু পোর্ট মিশিয়ে দাও। না, তার আগে আমাকে এটা ছোট আয়না এনে দাও। তাপর আমার পিঠে বালিশ চাপিয়ে একটু বসিয়ে দাও। তুমি রান্না করবে আর আমি বসে তা দেখবো।”
একঘন্টা পরে সে বললে, “স্যুডি, একদিন দেখো আমি নেপলস-এর উপসাগরটা ঠিকই আঁকবো।”
বিকেলবেলা ডাক্তার এলেন। ডাক্তার বিদায় নিতেই অজুহাত দেখিয়ে স্যু বাইরের হলঘরে গিয়ে তার সাথে দেখা করল।
“একটু আশা আছে,” ডাক্তার স্যুর হাতে হাত রেখে বললেন, “মনে হচ্ছে আপনার সেবার জোরেই আপনি জিতে যাবেন। এখন নীচতলায় আমাকে আরো এক রোগী দেখতে যেতে হবে- তার নাম রেবম্যান! লোকটা নাকি ছবি আঁকে। তারও বোধহয় নিউমোনিয়া হয়েছে। বুড়ো মানুষ, খুব দুর্বল হয়ে পড়েছে- অবস্থা খুব নাজুক। কোন আশা নেই। শুধু একটু আরাম দিতে তাকে হাসপাতালে পাঠাতে হবে।”
পরদিন সকালবেলা ডাক্তার এসে বললেন, “ওর আর কোনো বিপদ নেই, আপনিই জিতলেন। এখন শুধু একটু সেবাযত্ন আর পুষ্টিকর খাবার প্রয়োজন।”
সেদিন বিকেলবেলা জনসি যেখানে শুয়ে ছিল সে বিছানার পাশে স্যু এল। একটা নীল সস্তা পশমের স্কার্ফ বুনছিল সে। এক হাতে বালিশ সহ জনসির গলা জড়িয়ে ধরে সে।
“তোমাকে একটা কথা বলার আছে, জনসি,” স্যু বলল। “মিস্টার বেরম্যান আজ হাসপাতালে নিউমোনিয়ায় মারা গেছে। দু’দিন মাত্র অসুখে ভুগেছে। প্রথম দিনই দারোয়ান তাকে দেখতে পায় যে নীচে তার নিজের ঘরের মধ্যে পড়ে যন্ত্রণায় কষ্ট পাচ্ছে। তার জুতো, জামা সব ভিজে বরফ হয়ে গিয়েছিল। ওমন বৃষ্টির মধ্যে সেরাতে ও যে কোথায় গিয়েছিল কেউ জানে না। তারপর একটা লণ্ঠন দেখতে পায়, লন্ঠনটা তখনও জ্বলছিল। একটা মইও পড়ে ছিল, ওটাকে টেনে-হিচড়ে কোথাও নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। কয়েকটা তুলি, কিছু রঙ ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল, সবুজ আর হলুদ রঙ মেশানো একটি পেলেটও ছিল সেখানে। জানালার বাইরে চেয়ে দেখ, দেয়ালের গায়ে আইভিগাছে এখনও শেষ পাতাটা লেগে রয়েছে। কখনো কি তোমার মনে হয়নি ওটা বাতাসে কেন একটুও নড়ছে না? আহ্, প্রিয় বন্ধু, আসলে ওটাই হচ্ছে বেরম্যানের মাস্টারপিস, সেরা ছবি- শেষ পাতাটা যেদিন ঝরে যায়- সে রাতেই সে তার জীবনের শ্রেষ্ঠ ছবিটা এঁকে ওখানে রেখে গিয়েছে।”

 

 

শেষ পাতাটি  (The Last Leaf)

মূল লেখক : ও. হেনরী

ভাষান্তর: শাহ্জাহান মানিক

Sharing is caring!

Shajahan Manik

ইংরেজি প্রভাষক শাহ্জাহান মানিক একাধারে কবি, লেখক, গবেষক ও অনুবাদক। একাধিক কাব্যগ্রন্থ ছাড়াও তার অনুদিত বইয়ের সংখ্যা ১০টি। এছাড়া সায়েন্স ফিকশন, সম্পাদনা, ছোটদের বইয়ের পাশাপাশি তার রয়েছে ইংরেজি শেখার বই। তার সর্বশেষ প্রকাশিত গ্রন্থ হচ্ছে- মানব কল্যাণে মুসলিম বিজ্ঞানীদের অবদান।

https://besorgo.com

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *