মজার গল্প : ঝোলার বুদ্ধি

মজার গল্প : ঝোলার বুদ্ধি

ছোট গল্প নির্বাচিত পোস্ট

ঝোলার বুদ্ধি

এক আজব লোক আছে গ্রামে। নাম তার ঝোলা। বাড়িতে বসে বসে বাইন-কাইট করে আর আজব সব কা-কারখানা ঘটায়। একদিন তার বউকে বলে খুলাপিঠা করে দিতে। বউ পিঠা বানানোর কথা শুনে খুশি হয়। আয়োজন শেষ করে পিঠা বানাতে বসে যায়। পিঠা বানায় আর খায়। খেতে খেতে একসময় খেয়াল করে দেখে বেশিরভাগ পিঠা সে নিজেই খেয়ে ফেলেছে। তার স্বামীর জন্য পর্যাপ্ত পিঠা নাই। এদিকে ঝোলা পিঠা খাওয়ার অপেক্ষায় প্রহর গোনছে। তার বউ যতবার কড়াইয়ে গুলাগুড়ি ঢালে ততবারই ছ্যাৎ করে শব্দ হয়। ঝোলা ছ্যাৎ শব্দ শুনে আর মাটিতে দাগ দিয়ে রাখে। পিঠা বানানো শেষ হলে তার বউ পিঠা খাওয়ার জন্য ডাক দেয়। ডাক শুনে মনে মনে ভাবে যাইহোক আজ অনেকদিন পর পিঠা খাওয়া হবে। উঠে যাওয়ার আগে মাটিতে দেওয়া দাগ গোনে দেখে পনেরোটি দাগ হয়েছে।
লোকটি পিঠা খেতে বসেছে। বউ দিয়েছে মাত্র তিনখান পিঠা। পিঠা তিনখানা খেয়ে বলে আরও দাও। বউ বলে আর নাই। মোটে পাঁচখানা পিঠা বানিয়েছি। তোমাকে দিয়েছি তিনটা আর আমার জন্য রেখেছি দুইটা। খাওয়া থেকে উঠে যাওয়ার সময় ঝোলা বলে ‘ছ্যাৎ পন্ড খাইতে তিন।’ বউ বলে ‘হু, কিতা কইলায়? পন্ডটা পিঠা পাইলায় কই? অউ পাঁচখান পিঠাউ বানাইছি। তোমারে দিছি তিনখান আর আমার লাগি রাখছি দুখান। তোমারে একটা বেশি দিছি।’ ঝোলা কিছু না বলে চুপচাপ চলে গেল।
ঝোলার বউ পিঠা খেয়ে পাশের বাড়ি বেড়াতে গেল। ওই বাড়ির একটা গরু গতকাল হারিয়ে গেছে। অনেক খোঁজাখুজি করেও পায়নি। মহিলারা বসে এই গল্পই করতেছিল। এমন সময় ঝোলার বউ উপস্থিত এবং সব শুনে বলে, ‘এরে গো, তুমি এক কাজ করো, আমরা বাড়ির তাইনর কাছে যাও। তাইন গোনাবাছা জানোইন। এক্কইরবারে কইলিবা।’ হারানের বউ বলে, ‘হাছা কওনি? অখন গেলে তানে পাইমুনি? ঝোলার বউ কয়, ‘অয় যাও। অউ অখন তানে পুবর ঘরো থইয়া আইছি। গেলেউ পাইলিবায়।’
এখন হারানের বউ এসেছে ঝোলার বাড়িতে। এসে বলে, ‘ঝোলা দা, আমার একটা গরু কাইল থনে তুকাইয়া পাইরাম না। গরুটারেবা আমার বড় কাশির গরু। দামা।’ ঝোলার মনে পড়ে গেল আজ সকালে সে বলাই পুকুরের তেরাঝোপের আড়ালে প্রাতঃকৃত্য করার সময় দেখে এসেছিল গরুর গোবর এবং গরুর পদচারণার চিহ্ন। হারানের বউর কথা শোনে বলে, ‘ও আচ্ছা, দেখি কী হয়?’ মাথা নুইয়ে মাটিতে খড়ি দিয়ে আঁকিবুঁকি করে আর বিড়বিড় করে হিসাব করে। দুই থেকে তিন গেলেগি পাঁচ, চাইরে চাইরে দুই, তিন থেকে চাইর গেলেগি কত? . . . ইত্যাদি ইত্যাদি। হঠাৎ বলে, ‘পাইছি পাইছি। ছ্যাৎ পন্ড খাইতে তিন, তেরাউনিত গি বলদ চিন।’ মাথা তুলে বলে― ‘তেরাউনি চিননি গো? হারানের বউ বলে, ‘চিনি চিনি, অউতো দখিন ধারে।’ ঝোলা বলে, ‘যাও, গিয়ে বলদ খুঁজে দেখ। পাইবায়।’ বেটি ওখানে গিয়ে সত্যি সত্যি বলদ খুঁজে পেল। মনে মনে ভাবে, এ লোকটি তো সাংঘাতিক গণতা। এরকম লোক দেশে আর আছেনি! গরু নিয়ে বাড়িতে আসার পর সবার কাছে বলে ঝোলা গণকের কারণেই তার গরুটা পাওয়া গেল। এ মুখ থেকে সে মুখে করে করে সারা এলাকায় ছড়িয়ে গেল ঝোলার কবিরাজের ক্যারিশমার কথা। তার বেশ নামডাক হলো।
এর কয়েদিন পরে রাজবাড়ির একগাছি সোনার নেকলেস হারিয়ে গেল। অনেক খোঁজাখুঁজি করেও পাওয়া গেল না। নেকলেস চুরি করেছিল বাড়ির কাজের এক মহিলা। সে আতঙ্কিত কিন্তু স্বাভাবিক চলাফেরা করে সবার সাথে সেও নেকলেস খুঁজে। লোকমুখে রাজা শুনলেন ঝোলা কবিরাজের কথা। কবিরাজের কাছে লোক পাঠালেন। ঝোলা কবিরাজ তো রাজার আদেশ শুনে মহা চিন্তায় পড়ে গেল। আগের দুই ঘটনা তো সে দেখেছিল বলে ক্যারিশমা দেখিয়েছিল। কিন্তু এখন কী করবে? রাজার আদেশ। না গেলেও তো হবে না। কী আর করা! যা থাকে কপালে! জীর্ণশীর্ণ পুঁতিপত্রের পুটলি বেঁধে রাজবাড়ির উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করল। পথে যেতে যেতে বলে, ‘হায় বিধি কী করলায়! হায় বিধি কী করলায়! আইজ তো উপায় নাই, আইজ তো উপায় নাই! হায় বিধি কী করলায়!’
যে মহিলাটি নেকলেস চুরি করেছিল সে যাচ্ছিল ওই পথ ধরে। তার নাম ‘বিধি’। সে কবিরাজের মুখে এ কথা শুনে ভড়কে গেল। ধড়াম করে কবিরাজের পায়ে পড়ল। বলল, ‘কবিরাজ মশায়, আপনি তো বাড়িতে থেকেই সব জেনে গেলেন। আপনি আমাকে বাঁচান। রাজার বাড়িতে গিয়ে যদি একথা বলেন রাজা আমার গর্দান নেবে। এক কাজ করেন, আমার কথা বলবেন না। বলবেন রাজবাড়ির গোবরের গাতে ঈশান কোণে নেকলেস পাওয়া যাবে। আমি ওখানে রেখে দেব।’ ঝোলা কবিরাজ তখন বলে, ‘যা বেটি যা, আমি তো বাড়িত থাকিই করাম তুই যে নিছত। যা চিন্তা করিস না। দেখি কী হয়!’ তখন বিধি রানি ঝোলা কবিরাজের হাতে পায়ে ধরে, কান্নাকাটি করে, কাকুতি মিনতি করে বাড়িতে গেল।
রাজ বাড়িতে গিয়ে দেখে অনেক মানুষ জমায়েত হয়েছেন। ঝোলা কবিরাজের কেরামতি দেখার জন্যই মানুষের এই ভিড়। কবিরাজ উপস্থিত হওয়া মাত্র তাকে লোকজন সমাদর করে বলল, আসেন কবিরাজ মশায়, আসেন। রাজা আপনার জন্য অপেক্ষা করছেন। তাকে বসার জন্য সুন্দর আসন দেওয়া হলো। সেও মনে মনে ভাবে চিন্তার কারণ নাই। বিধি তো বিধির কাজ করেছে। এবার আমার কাজ আমি করি। তার পুটলি থেকে খাতাপত্র বের করে ধ্যান ধরে কিছুক্ষণ বসল। মাথা নুইয়ে মাটিতে খড়ি দিয়ে আঁকিবুঁকি করল আর বিড়বিড় করে আগের মতোই হিসাব করল ‘দুই থেকে তিন গেলেগি পাঁচ, চাইরে চাইরে দুই, নয় থেকে ছয়. . . ইত্যাদি। হঠাৎ বলে, ‘পাইছি পাইছি। ছ্যাৎ পন্ড খাইতে তিন, তেরাউনিত গি বলদ চিন। রাজার বাড়ি হারছড়া গোপরর গাতোর ঈশান কোণায় দেখা যায়। আপনারা কেউ ভালো- কয়েকজন যাউকাচাইন। গোপরর গাতোর ঈশান কোণাবায় হারছড়া আছে। আউলাঝাউলা করইন না যে, অনঅ গিয়া পাইবা।’ সাথে সাথে তিন জন লোক গেলেন। ঈশান কোণায় কিছুটা গোবর উলট-পালট দেখে একজন আলতো করে গোবর সরিয়ে দেখে নেকলেস। ‘পাইলিছি, পাইলিছি’ বলে চিৎকার করতে করতে রাজার কাছে এসে নেকলেস দিল। সবাই বলাবলি করতে লাগলো, ‘বাহ্! বাহ্! গণতা কিন্তু বড় ডাট গণতা!’
রাজা খুশি হয়ে কবিরাজকে প্রচুর ধনসম্পদ দান করলেন। লোকে পথে যেতে যেতে ঝোলা কবিরাজের প্রশংসা করছিল। অন্য এক কবিরাজের এসব শুনে সহ্য হচ্ছিল না। সে ঝোলা কবিরাজকে পরীক্ষা করার জন্য একটা ফড়িং ধরে হাতের মুঠোয় লুকিয়ে রেখে কবিরাজের পিছু নিল। আর কয়েকজন লোককে বলল যে তোমাদের ঝোলা কবিরাজ যদি আমার এই হাতের মুঠোয় কী আছে তা বলতে পারে তবেই বুঝব সে প্রকৃত গণক। চলো সবাই মজা দেখি। কবিরাজের কাছে গিয়ে বলল, ‘গণতা মাশয়, দমলউকা দমউলকা।’ ঝোলা বলে, ‘কিতা, কউকা?’ আপনি বলেন আমার হাতে কী আছে? ঝোলা কবিরাজ তো পড়ল মহা মুশকিলে। মনে মনে ভাবে এখন যদি এই লোকটারে সন্তুষ্ট করতে না পারে তাহলে তো ইজ্জত শেষ। তার স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে আবারও বিড়বিড় শুরু করল―
ছ্যাৎ পন্ড খাইতে তিন,
তেরাউনিত গি বলদ চিন,
এতদিন খাইছলায়রে ঝোলা
গোনিয়া আর বাছিয়া,
আইজ বুঝি যাইতায় রে ঝোলা
ফড়িঙ্গা আগা আগিয়া।
ফড়িঙ্গা শব্দটি একটু জোরেই বলেছিল ঝোলা। যেইমাত্র লোকটি ‘ফড়িঙ্গা’ শব্দটি শুনল, অমনি বলে উঠল― ‘হেই কইলিছইনরে কইলিছইন’। দিল তার হাতের মুঠোর ভিতর থেকে ফড়িং ছেড়ে। সবাই দেখল আর বলাবলি করতে লাগল, ‘দেখরায়নি বা এক গণতা! বড় ডাট্ গণতা!’

 

বি.দ্র. (লোককাহিনি অবলম্বনে সামান্য পরিবর্তিত ভাবে লেখা । এই মজার গল্পটি বলেছিলেন নরেন্দ্র শব্দকর। বর্তমানে তার বয়স প্রায় ৭২ বছর। গল্পটির কথোপকথন সিলেটের আঞ্চলিক ভাষায় হয়েছে।)

 

শব্দার্থ:
খুলাপিঠা= চালের গুড়ি দিয়ে বানানো এক ধরনের পিঠা,
পন্ড= পনেরো,
কিতা= কী,
তাইন= তিনি,
গোনাবাছা= কবিরাজি,
হাছা= সত্যি,
থনে= থেকে,
তুকাইয়া পাইরাম না = খোঁজে পাচ্ছি না।
কাশির গরু= পছন্দের গরু।
দামা= ষাঁড়,
আমি তো বাড়িত থাকিই করাম তুই যে নিছত= আমি তো বাড়িতে থেকেই বুঝতে পেরেছি তুই যে নিয়েছিস। করাম<কইরাম=বলছি,
যাউকাচাইন= গিয়ে দেখুন,
আউলাঝাউলা= এলোমেলো,
অনঅ= ওখানে,
পাইলিছি= পেয়েছি,
গণতা= কবিরাজ,
ডাট= শক্ত (দক্ষ অর্থে),
দমলউকা= অপেক্ষা করুন বা একটু দাঁড়ান,
কিতা, কউকা?= কী, বলেন।
তেরাউনি= তেরা নামক এক ধরনের বন্য উদ্ভিদের ঝোপ।
আইজ বুঝি যাইতায় রে ঝোলা/ফড়িঙ্গা আগা আগিয়া= গণপিটুনিতে মলত্যাগসহ মরণাপন্ন অবস্থা হওয়া।

তারিখ: ২১/০৪/২০২২ খ্রি.

Sharing is caring!

Dipankar Shil

দীপংকর শীল একজন অনুসন্ধানী লেখক। ‌তার প্রকা‌শিত গ্রন্থ "কুরুখ ভাষা শেখার প্রথম পাঠ" (২০২২), "উরাং জনগোষ্ঠীর কুরুখ ভাষা প‌রিচয় ও অ‌ভিধান" (২০২২)। বি‌ভিন্ন সা‌হিত্য প‌ত্রিকা সম্পাদনা ক‌রে‌ছেন। এছাড়াও বি‌ভিন্ন পত্রপ‌ত্রিকায় তার অ‌নেক প্রবন্ধ প্রকা‌শিত হ‌য়ে‌ছে। বর্তমা‌নে তিনি একটি সরকারি ক‌লে‌জে বাংলা বিভাগের প্রভাষক পদে দায়িত্ব পালন করছেন।

1 thought on “মজার গল্প : ঝোলার বুদ্ধি

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *