হোটেল এভারেস্ট ভিউ এর আদ্যোপান্ত

হোটেল এভারেস্ট ভিউ এর আদ্যোপান্ত

জানা অজানা নির্বাচিত পোস্ট ভ্রমন ও বিনোদন

হোটেল এভারেস্ট ভিউ

প্রকৃতি বেষ্টিত বিশ্বের সর্বোচ্চ বিলাসবহুল হোটেল
হোটেল এভারেস্ট ভিউ সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে ১৩,০০০ ফুট উপরে প্রাকৃতিক পরিবেশ বেষ্টিত একটি বিলাসবহুল হোটেল। বিশ্বের সর্বোচ্চ বিলাসবহুল হোটেল হিসেবে এটি গিনেস বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডের (২০০৪) তালিকায় রয়েছে। এই হোটেলের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এর প্রতিটি রুম থেকে এভারেস্ট সহ এই রেঞ্জের আরো কিছু পর্বতের সুন্দর দৃশ্য উপভোগ করা যায়। ১৯৭১ সালে এটি চালু করা হয়। হিমালয়ের ৩৬০ ডিগ্রি ভিউ এই হোটেলের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
নেপালের খুমজুং গ্রামের প্রাণকেন্দ্রে উঁচুতে অবস্থিত, হোটেল এভারেস্ট ভিউ হিমালয়ের রুক্ষ অভিজাত সৌন্দর্যের মাঝে বিলাসবহুলতার প্রতীক হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে। ১৩,০০০ ফুট উচ্চতায় বিশ্বের সর্বোচ্চ শৃঙ্গগুলির মধ্যমণি হয়ে অপার পাহাড়ের মহিমা ও সৌন্দর্যকে স্পর্শ করার পাশাপশি নেপালি আতিথেয়তার অতুলনীয় অভিজ্ঞতা এখানে উপভোগ করা যায়।
সাধারণত এভারেস্ট বেস ক্যাম্প ট্র্যাকের কঠিন সময়গুলিতে পথিমধ্যে বিলাসবহুল হোটেল খুঁজে পাওয়া যায় না। আর সে প্রত্যাশা পূরণে ট্র্যাকের পাশে সেরা আবাসন এবং খাবারের সুবিধা দিতে সৌখিন ট্রাকারদের জন্য নির্মিত হয়েছে এই হোটেল। হোটেলটিতে রুম হিটিং, ফ্রি ওয়াইফাই, লন্ড্রি পরিষেবা, তারকা রেঁস্তোরা, বার এবং দুর্দান্ত সব খাবার ও পানীয়ের ব্যবস্থা রয়েছে। হিমালয় ট্র্যাকিংকালে অন্য কোন হোটেল বা গেস্ট হাউসে একসাথে এইসব সেবা পাওয়া সম্ভব নয়। এই হোটেলের ব্যালকনি বা রোঁস্তারা, এমনকি রুমে বসে চা পান করতে করতে একই সাথে এভারেস্টের অলৌকিক দৃশ্য উপভোগ সহ লোটসে, থামসেরকু, আমা দাবলাম ও অন্যান্য পর্বতমালার উঁচু শৃঙ্গ দর্শন করা সম্ভব। তাই এই হোটেলের জনপ্রিয়তা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। একইসাথে সৌন্দর্য ও মিডিয়া কভারেজের কারণে এই হোটিলটি নিজেকে অনন্য এক বৈশিষ্ট্যে পরিণত করেছে।

হোটেল এভারেস্ট ভিউ এর ইতিহাস

হোটেল এভারেস্ট ভিউ প্রতিষ্ঠা করা হয় ১৯৭১ সালে। এর আগে ১৯৬৮ সালের বসন্তে তাকাশি মিয়াহারা নামক এক জাপানী উদ্যোক্তা ও ভ্রমণাপিপাসু এই এলাকা ভ্রমণকালে এখান থেকে প্রথম এভারেস্ট পর্বতটি দেখেন। শ্বাসরুদ্ধকর সেই দৃশ্যটি তার হৃদয়কে নাড়া দেয়। এই স্থানের প্রেমে পড়ে যান তিনি। তখনই স্বপ্ন দেখেন যে একদিন ঠিক এই জায়গায় তিনি একটি বিশ্বমানের হোটেল তৈরি করবেন। সেই হোটেলটি এমন একটি হোটেল হবে যেখানে অতিথিরা আরামদায়কভাবে বসে বিশ্বের সর্বোচ্চ পর্বত এভারেস্ট দেখতে পাবে। তারপর তিনি তার স্বপ্ন বাস্তবায়নে লেগে যান।

নকশা ও স্থাপত্য

তাকাশি মিয়াহারা উদ্যোগে জাপানি স্থপতি ইয়োশিনোবু কুমাগায়ার ডিজাইনে হোটেলটি বাস্তবায়নে বেশ কয়েক বছর লেগে যায়। হোটেলটির নকশা করা হয়েছিল এমনভাবে যাতে এটি প্রাকৃতিক পরিবেশের সাথে মিশে থাকে। এমনকি হোটেলটির নির্মাণ কাজ খুব সাবধানে সম্পন্ন করা হয়েছিল যেন হিমালয়ের চমৎকার পরিবেশে ও আশেপাশের স্থানীয় সংস্কৃতির কোনো ক্ষতি না হয়।
৩৮৮০ মিটার উচ্চতায় একটি হোটেল তৈরি করা সত্যিই একটি সাহসী কাজ। বিশেষ করে ৬০ এর দশকে এটি তৈরি করা কতোটা কঠিন এবং চ্যালেঞ্জিং ছিল তা ভাবাও দুরুহ। সেই সময় কোনও রাস্তা ছিল না। বিভিন্ন বাধার সম্মুখীন হতে হতো। লামুসাঙ্গু থেকে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র দুই সপ্তাহের ট্রেকে স্থানীয় শেরপাদের সহায়তায় আনা হতো। ভারী উপকরণসমূহ হেলিকপ্টারের মাধ্যমে পরিবহন করা হয়েছিল। হোটেলের কক্ষগুলিতে ব্যবহৃত স্লাাইডিং কাঁচের দরজা, সোলারিয়ামের জন্য গ্লাস, কম্বল এবং খাবারের পাত্রের মতো উপকরণগুলি জাপান থেকে আমদানি করা হয়। প্রথমে এগুলো কলকাতার একটি বন্দরে পাঠানো হয় এবং তারপর পোঁছানো হয় নেপালে। ১৯৭১ সালে হোটেলটির দরজা খুলে দেয়া হয় দর্শনার্থীদের জন্য।

 

Hotel Everest View
হোটেল এভারেস্ট ভিউ

হোটেল এভারেস্ট ভিউ হাইকিং ট্রেক যে কারণে জনপ্রিয়

মাউন্ট এভারেস্টের একটি অলৌকিক দৃশ্য অবলোকন করার জন্য হোটেল এভারেস্ট ভিউ হাইকিং হচ্ছে অন্যতম সেরা হাইকিং ট্রেক। বলা হয়ে থাকে হোটেল এভারেস্ট ভিউ হাইকিং নেপালের অনন্য হিমালয় ট্রেক। সাধারণত, এভারেস্ট অঞ্চলের ট্রেক কঠিন। তবে হোটেল এভারেস্ট ভিউ ট্রেক হচ্ছে মাউন্ট এভারেস্ট দেখার সবচেয়ে সহজ পন্থা। হোটেল এভারেস্ট ভিউ হাইক একটি ছোট কোলাহলমুক্ত ট্রেক এবং পারিবারিক ভ্রমণের জন্য উপযুক্ত বলে বেশি জনপ্রিয়। এই ট্রেককে তুলনামূলকভাবে সহজ এবং শর্ট ট্রেক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কারণ এটি এভারেস্ট বেস ক্যাম্প ট্রেকের মতো খুব বেশি উচ্চতায় পৌঁছায় না এবং ততো চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয় না। যারা হিমালয়ের সৌন্দর্য দেখতে চান কিন্তু দীর্ঘ ও কঠিন ট্রেক করতে চান না তাদের জন্য এবং নতুন ট্রেকারদের জন্য হোটেল এভারেস্ট ভিউ ট্রেক একটি দারুন উপভোগ্য গন্তব্য।
এই ট্রেকে এভারেস্ট (৮৮৪৮ মি.), লোটসে (৮৫১৬ মি.), আমা দাবলাম (৬৮৫৬ মি.), থামসেরকু (৬৬০৮ মি.), নুপ্তসে (৭১৬৮ মি.) সহ অন্যান্য হিমালয় পর্বতশ্রেণীর চমৎকার প্যানোরামা উপভোগ করা যায়।
এছাড়াও ট্রেকাররা স্থানীয় শেরপা সংস্কৃতি, তাদের জীবনযাত্রা, তেনজিং নরগে এবং এডমন্ড হিলারির প্রতিষ্ঠিত বিভিন্ন বিদ্যালয় ও ক্লিনিক পরিদর্শন করতে পারেন। পথে টেংবোচে বিখ্যাত প্রাচীনতম বৌদ্ধ বিহারটি সবার নজর কাড়ে। স্থানীয়দের কাছে এই বিহার খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
বিশেষ করে হিমালয় দর্শনের জন্য নামচি বাজার থেকে এভারেস্ট ভিউ ট্রেক হোটেলটির সংক্ষিপ্ত ট্রেকটি দারুন উপভোগ্য। ৫.৪ কি.মি দৈর্ঘ্যরে ৩/৪ ঘন্টার এই রাউন্ড ট্রিপটি যে কারোর কাছে একটি স্মরণীয় অভিজ্ঞতা হবে। এখানে অবস্থিত সাগরমাথা জাতীয় উদ্যান খুম্বু অঞ্চলের আরেকটি জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র। ট্রেকাররা এই জাতীয় উদ্যানে হিমালয়ের বিরল প্রাণী, পাখি এবং গাছপালা দেখতে পারেন। সবচেয়ে আনন্দের বিষয় এই যে, চলার পথে অনেক মহান অভিযাত্রী এবং পর্বত আরোহীদের সাথে সাক্ষাৎ হবে।

 

এই পথে ট্র্রেকারদের ভালো ফিজিক্যাল কন্ডিশনে থাকতে হয়। উচ্চ উচ্চতায় হাঁটার সময় সতর্ক থাকতে হয়। উচ্চতা পরিবর্তন এবং ঠান্ডা আবহাওয়ার কারণে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে। প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি ও অভিজ্ঞ গাইডের সাহায্যে অবশ্য এই সমস্যা মোকাবেলা করা সম্ভব।

 

ট্রেক এর বিবরণ

হোটেল এভারেস্ট ভিউ পুরো ট্রেকে সাধারণত ৫ থেকে ৭ দিন সময় লাগে। নতুন ট্রেকারদের জন্য এটি উপযুক্ত। ট্রেকটি লুকলা থেকে শুরু হয়। পর্যটকরা সাধারণত কাঠমুন্ডু থেকে ফ্লাইটে করে লুকলা যান। লুকলা থেকে ট্রেক শুরু করে পর্যটকরা প্রথমে পাকদিং গ্রামে যান এবং সেখান থেকে নামচি বাজারে পৌঁছান, যা খুম্বু অঞ্চলের প্রধান বাণিজ্যিক কেন্দ্র।
উচ্চতার সঙ্গে অভিযোজনের জন্য নামচি বাজারে একটি দিন থাকতে হয়, যাকে “অ্যাক্লিমেটাইজেশন” বলে।
নামচি বাজার থেকে পরবর্তী গন্তব্য হলো ৩,৮৮০ মিটার (১২,৭৩০ ফুট) উচ্চতায় অবস্থিত হোটেল এভারেস্ট ভিউ। সেখানে হোটেলে ২/১ দিন থেকে পুনরায় ফিরতি পথে ফিরে আসতে হয়।

হোটেল এভারেস্ট ভিউতে থাকার খরচ কত?

হোটেল এভারেস্ট ভিউ হাইকিং নেপালের সবচেয়ে ব্যয়বহুল ট্রেকগুলির মধ্যে একটি। রাত্রিযাপন এবং সমস্ত খাবারের মূল্য সহ রুম ভাড়া খরচ সাধারণত ৩৮০ ডলার থেকে থেকে ৪৩০ ডলার পর্যন্ত হয়ে থাকে। অপরদিকে লুকলা ফ্লাইট সহ সাত দিনের ট্রেক এবং হোটেল এভারেস্ট ভিউতে থাকা খরচ ১২০০ ডলার থেকে ১৪ড়ড় ডলার হতে পারে ।
তবে হেলিকপ্টার করেও সরাসরি কেউ হোটেল এভারেস্ট ভিউ যেতে পারে এবং সেখানে বসে দৃশ্যাবলী উপভোগ করতে পারেন। এ ক্ষেত্রে এক রাত হোটেলে থাকা সহ মোট খরচ ৩০০০-৫০০০ ডলার পর্যন্ত খরচ হবে।
খরচ কমাতে চাইলে শীত মৌসুমে ট্রেকিং করা ভালো। এই বিলাসবহুল হোটেলটিতে মাত্র দশটি কক্ষ রয়েছে। তাই বসন্ত ও শরতের মতো পিক সিজনে হোটেল এভারেস্ট ভিউতে হাইকিং করতে চাইলে অবশ্যই হোটেলটি প্রি-বুক করতে হবে।
বিশ্বের উচ্চতম শৃঙ্গের পাদদেশে অবস্থিত হোটেল এভারেস্ট ভিউ হিমালয়ের মহিমা আবিষ্কার করে অনন্য অভিজ্ঞতার জন্ম দেয়। আজ এটা শুধু হোটেল নয়; এটি বিস্ময়, দুঃসাহসিকতা এবং নির্মল সৌন্দর্যের জগতের একটি প্রবেশদ্বার হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই সুযোগ গেলে অনন্ত একবার হলেও এ অভিজ্ঞতা উপভোগ করা উচিত। কেননা ভ্রমণ মানুষের মন ও হৃদয়কে নির্মল করে।

Sharing is caring!

Shajahan Manik

ইংরেজি প্রভাষক শাহ্জাহান মানিক একাধারে কবি, লেখক, গবেষক ও অনুবাদক। একাধিক কাব্যগ্রন্থ ছাড়াও তার অনুদিত বইয়ের সংখ্যা ১০টি। এছাড়া সায়েন্স ফিকশন, সম্পাদনা, ছোটদের বইয়ের পাশাপাশি তার রয়েছে ইংরেজি শেখার বই। তার সর্বশেষ প্রকাশিত গ্রন্থ হচ্ছে- মানব কল্যাণে মুসলিম বিজ্ঞানীদের অবদান।

https://besorgo.com

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *