ঈশ্বরচন্দ বিদ্যাসাগর;

বিদ্যাসাগর : জীবন-ই যার বাণী

জীবনী প্রবন্ধ
‘যে ব্যক্তি যে দেশে জন্মগ্রহণ করেন, সে দেশের হিতসাধনে সাধ্যানুসারে সচেষ্ট ও যত্নবান হওয়া তাহার পরম ধর্ম ও তাহার জীবনের প্রধান কর্ম,’ কথাটি ঈশ্বরচন্দ্র শর্মা-র, যাকে আমরা ঈশ্বরচন্দ বিদ্যাসাগর বলে জানি। শুধু বলার জন্য বলা নয়, তিনি আজীবন দেশের ও দেশের মানুষের হিতসাধনে কাটিয়েছেন। ফলশ্রুতিতে তিনি হয়েছেন ভারতবর্ষের এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী এবং অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব।

অতুলনীয় এই মানুষটিকে মানুষ চেনে একাধারে বিদ্যাসাগর, সমাজ সংস্কারক, শিক্ষা সংস্কারক, বিধবা বিবাহ প্রবর্তক, দয়ারসাগর, করুণাসাগর, রসেরসাগর, ভারতীয় নবজাগরণের পথিকৃৎ, আধুনিক পুরুষ, মাতৃভক্ত, বাংলা গদ্যের জনক, সাহিত্যিক, পাঠ্যপুস্তক রচয়িতা, অনুবাদক, ইত্যাদি বহু বিশেষণে।

তাঁর চরিত্র মুল্যায়ন করতে গিয়ে মাইকেল মধুসূদন দত্ত বলেছেন, ‘প্রাচীন ঋষির ন্যায় প্রতিভা ও প্রজ্ঞা, একজন ইংরেজের মতো কর্মশক্তি, আর হৃদয় হচ্ছে বাঙালি মায়ের অনুরূপ।’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, ‘দয়া নহে, বিদ্যা নহে, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের চরিত্রে প্রধান গৌরব তাঁহার অজেয় পৌরুষ, তাঁহার অক্ষয় মনুষ্যত্ব।’ তিনি আরও বলেছেন, ‘বিশ্বকর্মা যেখানে চারকোটি বাঙালি নির্মাণ করিতেছিলেন সেখানে হঠাৎ দু-একজন মানুষ গড়িয়া বসেন কেন, তাহা বলা কঠিন।’ ক্ষণজন্মা এই মানুষটির পুরো জীবনই যেন বাণী সমৃদ্ধ। ইন্দ্রমিত্র তাঁর ‘করুণাসাগর বিদ্যাসাগর’ গ্রন্থে এই মহান ব্যক্তির বাস্তব ঘটনাবলি তুলে ধরেছেন। তাঁর জীবনকাহিনি যতই আস্বাদ করা যায়, ততই যেন তা আস্বাদ্য হয়ে উঠে। তিনি ছিলেন যথার্থই বড় মানুষ। আর বড় মানুষের কথা বারবার শুনতে হয়।
অসহায় মানুষকে সাহায্য করতেন বলে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে বলা হতো দয়ারসাগর। তাঁর কাছে সাহায্য চেয়ে খালি হাতে ফিরে গেছে এমন দৃষ্টান্ত মিলে না। বহু ব্যক্তি তাঁর সাহায্য সহযোগিতায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। তাঁরমধ্যে একজন হলেন মহাকবি নবীনচন্দ্র সেন। তিনি বিদ্যাসাগরের চারিত্র্যিক বৈশিষ্ট্য সম্বলিত একটি কবিতা রচনা করেছিলেন। সেখানে বিদ্যাসাগরকে অলংকৃত করে বলেছেন, ‘কাঙাল বিধবা বন্ধু অনাথের নড়ি’। সত্যি বিদ্যাসাগর কাঙাল, বিধবা, অনাথ তথা অসহায় গরির মানুষের বন্ধু। দাতাকর্ণের মতো সারাজীবন দান করে গেছেন। জীবনের অন্তিমকালেও তাঁর জমানো ধনসর্বস্ব বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নামে উইল করে গেছেন। বিপন্ন মানুষকে সাহায্য করাই ছিল তাঁর জীবনধর্ম। তাঁর দয়ার জন্য সাধারণ মানুষের কাছে তিনি ‘দয়ারসাগর’।

বিদ্যাসাগর যেভাবে দয়ারসাগর হলেন

কবে থেকে তিনি ‘দয়ারসাগর’ হিসেবে পরিচিত হলেন তার একটা ঘটনা হলো এই- ১৮৬৬ সালের মাঝামাঝি দারুণ দুর্ভিক্ষ দেখা দিল এদেশে। শাকপাতা, শেকড়-বাকড় খেয়ে দিন কাটাতে লাগল মানুষ। একমুটো ভাতের অভাবে দিকে দিকে মানুষজন মরে যাচ্ছে। চতুর্দিকে হাহাকার। বিদ্যাসাগরের নিজ গ্রামেও আকাল পড়েছে। তিনি তাঁর গ্রাম বীরসিংহে একটা অন্নছত্র খুলে দিলেন। বীরসিংহ গ্রামের সেই অন্নছত্রে বারোজন লোক দিনরাত রান্না করত, পরিবেশন করত কুড়িজন লোক। অন্নছত্রে ক্রমে ক্রমে ভিড় বাড়তে লাগল, শেষে অবস্থা এমন দাঁড়াল যে দিনরাত খেতে দিয়েও কুল পাওয়া যায় না। বিদ্যাসাগর তখন বলেছেন, ‘যত টাকা খরচ হোক, কেউ যেন অভুক্ত না থাকে। সকলেই যেন খেতে পায়।’ দুর্ভিক্ষের সময় প্রায়ই বীরসিংহে যেতেন বিদ্যাসাগর। অন্নছত্রে মেয়েরাও খেতে আসে। পেটে ভাত নেই, মাথায় তেল দিবে কোথা থেকে। তেলের অভাবে মাথার চুল রুক্ষ হয়ে উঠল। দেখে বিদ্যাসাগর প্রত্যেকের জন্য তেলের ব্যবস্থা করে দিলেন। যারা তেল বিলি করত, তারা খুব সাবধানে কাজ করত। হাড়ি-মুচি-ডোম প্রভৃতি নীচু জাতের মেয়েদের সঙ্গে যদি ছুঁয়াছুয়ি হয়ে যায়, এই আশঙ্কায় তারা তফাৎ থেকে তেল দিত। আহা, এভাবে কি মানুষকে কিছু দিতে হয়। বিদ্যাসাগর নিজেই এগিয়ে এলেন তখন। নিজের হাতেই তিনি নিচু জাতের গরিব দুঃখিনীদের রুক্ষ চুলে তেল মাখিয়ে দিতে লাগলেন।
নিজ হাতে নিচু জাতের মেয়েদের মাথায় তেল মাখানোর ঘটনার প্রেক্ষিতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, ‘এই ঘটনা শ্রবণে আমাদের হৃদয় যে ভক্তিতে উচ্ছ্বসিত হইয়া উঠে তাহা বিদ্যাসাগরের দয়া অনুভব করিয়া নহে। কিন্তু তাহার দয়ার মধ্য হইতে যে- একটি নিঃসংকোচ বলিষ্ঠ মনুষ্যত্ব পরিষ্ফুট হইয়া উঠে তাহা দেখিয়া, আমাদের এই নীচ জাতির প্রতি চিরাভ্যস্ত ঘৃণা-প্রবণ মনও আপন নিগূঢ় মানবধর্মবশত ভক্তিতে আকৃষ্ট না হইয়া থাকিতে পারে না।’ যাইহোক, অন্নছত্রে যারা খেত তারা একবার বিদ্যাসাগরকে বলল- খিচুড়ি খেতে খেতে অরুচি হয়ে গেছে। সপ্তাহে একদিন মাছ-ভাত হলে ভালো হয়। তথাস্তু। সপ্তাহে একদিন ভাতের ব্যবস্থা করে দিলেন বিদ্যাসাগর। ভাত, পোনা মাছের ঝোল আর দই। দুর্ভিক্ষে বিদ্যাসাগর অনেক মানুষকে মৃত্যুর কবল থেকে রক্ষা করেছেন। আর এই সময় থেকেই দীন-দুঃখীরা তাঁকে ‘দয়ারসাগর’ বলে ডাকতে আরম্ভ করে।
বিদ্যাসাগরের সময়কালে অর্থাভাব ছিল প্রচুর। শিক্ষার হার ছিল অতি নগন্য। প্রাচীন পদ্ধতির জীবন যাপন মানুষকে যথেষ্ট সুখী করতে সক্ষম ছিল না। কুসংস্কারাচ্ছন্ন ও গোঁড়ামিতে পরিপূর্ণ ছিল মানুষের মন। অসহায় মানুষের দুঃখ দেখে তিনি সহ্য করতে পারতেন না। তাই তিনি সাহায্য করতেন। গরিব দুঃখী মানুষকে সাহায্য করলে পুণ্য হবে, স্বর্গে যাওয়া যাবে- এ রকম কোনো চিন্তা কিন্তু বিদ্যাসাগরের ছিল না। বস্তুতই তিনি মানুষের কষ্ট সহ্য করতে পারতেন না। তাঁর সময়েও ধনী মানুষের অভাব ছিল না। তাদের ধন ছিল, কিন্তু মন ছিল না। তারা শুধু নিজের স্বার্থের কথাই চিন্তা করত। গরিব দুঃখীর কথা চিন্তা করা তো দূরে থাক- তাদেরকে এড়িয়ে চলাই কর্তব্য মনে করত। সুবিধা বঞ্চিত এই মানুষদের কথা তিনি ভাবতেন, কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করলে গরিব মানুষেরা উপকৃত হবে তা নিয়ে শাসকদের সাথে দেনদরবার করতেন। গরিব মানুষের দুঃখ-ব্যথা ছিল তাঁর নিজের দুঃখ-ব্যথা। তিনি বলেন, ‘দরিদ্রের দুঃখ কয়জন দেখিয়াছে, তাঁহাদের হৃদয়ের ব্যথা কয়জন বুঝিয়াছে।’ এই গভীর উপলব্ধিই তাঁকে গরিব-দুঃখী মানুষকে সাহায্য করতে প্রাণিত করেছে।

ভিখারির জীবন পাল্টে দিলেন বিদ্যাসাগর

সাধারণ মানুষ ভিক্ষুককে ভিক্ষা দেয়- তার মধ্যে না থাকে শ্রদ্ধা না থাকে সাহায্য করার মনোভাব। অবজ্ঞাভরে কিছু একটা হাতে দিয়ে আপদ বিদেয় করতে পারলেই বাঁচে, অথবা বলে ‘মাফ করো।’ কিন্তু বিদ্যাসাগরের কাছে কোনো ভিক্ষুক পৌঁছাতে পারলে তার জীবনটা কেমন বদলে যেতো তারও দৃষ্টান্ত আছে। একদিন একটি ছেলে বিদ্যাসাগরের কাছে একটি পয়সা ভিক্ষা চাইল। ছেলেটির কঙ্কালসার চেহারার দিকে তাকিয়ে কী জানি কী মনে হলো, বিদ্যাসাগর বললেন, ‘আমি যদি চারটি পয়সা দিই?’
চেয়েছে তো একটি পয়সা, কিন্তু ইনি দিতে চাচ্ছেন চারটি পয়সা। এক পয়সা চাইলে কেউ কখনো চার পয়সা দেয়? ইনি নির্ঘাত ঠাট্টা করছেন! ছেলেটি মনে মনে ভাবল। বলল, ‘ঠাট্টা করছেন কেন? একটি পয়সা-ই দিন।’
বিদ্যাসাগর বললেন, ‘ঠাট্টা নয়, যদি চারটি দিই, তাহলে কী করবি?’
ছেলেটি বলল, ‘তাহলে দুইটি পয়সার খাবার কিনব আর দুটি পয়সা মাকে গিয়ে দিব।’
বিদ্যাসাগর বললেন, ‘যদি দু-আনা দিই?’
ছেলেটির মনে হলো আসলে ইনি কিছুই দিবেন না, শুধু শুধু ঠাট্টা করছেন। তাই কোনো কথা না বলে ছেলেটি চলে যাবার জন্য পা বাড়ালো। বিদ্যাসাগর হাত ধরে ফেললেন। বললেন, ‘বল না, সত্যি সত্যি তাহলে তুই কী করবি?’
ছেলেটির চোখ থেকে দু’ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল। বলল, ‘চার পয়সার চাল কিনে নিয়ে বাড়ি যাবো। আর চার পয়সা মাকে দিব। তাতে আমাদের আরেকদিন চলবে।’
বিদ্যাসাগর বললেন, ‘যদি চার আনা দিই?’কেউ কখনো চার আনা ভিক্ষা দিতে পারে! স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে এসব শুধু কথার কথা, এসব কথার উত্তর না দিলেও চলে। কিন্তু উত্তর না দিয়েও উপায় নেই। কেননা, তখনো বিদ্যাসাগর ছেলেটির হাত ধরে আছেন। সে বলল, ‘তাহলে দু-আনায় দুদিন খাওয়া চলবে আর দু-আনার আম কিনব। আম কিনে বেচব। দু-আনার আমে চারআনা হবে। তাহলে আবার দুদিন চলবে। আবার দু-আনার আম কিনব। এভাবে যতদিন চলে।’ চার আনা নয়, ছেলেটিকে পুরোপুরি একটি টাকা দিলেন বিদ্যাসাগর।
কিছুকাল পরে বিদ্যাসাগর আবার বর্ধমানে গেছেন। স্টেশনে নেমে একটা চেনা দোকানে ঢুকতে যাচ্ছেন, এমন সময় একটি ছেলে এসে বলল- দয়াকরে একবার আসুন, আমার দোকানে একবার বসতে হবে। বিদ্যাসাগর বললেন, ‘তুমি কে? আমি তো তোমায় চিনি না, তোমার দোকানে কেন যাব?’ ছেলেটি বলল, ‘আপনার মনে নেই। দু-বছর আগে আমি আপনার কাছে একটি পয়সা চেয়েছিলাম। আপনি আমাকে একটি টাকা দিয়েছিলেন। সেই একটি টাকায় দু-আনার চাল কিনেছিলাম আর বাকি চৌদ্দ আনার আম কিনে বিক্রি করেছিলাম। তাতে আমার বেশ লাভ হয়। তারপর আবার আম কিনে বেচি। ক্রমে লাভ বাড়তে থাকে। এটা-সেটা বেচে বেশ পুঁজি হয়। এখন এই মণিহারি দোকানখানি করেছি।’ বিদ্যাসাগরের মনে পড়ে গেল। হ্যাঁ, একটি টাকা দিয়েছিলেন বটে। ওকে আশীর্বাদ করলেন বিদ্যাসাগর। ওর দোকানে গিয়ে বসলেন। এভাবে তিনি এক ভিখারিকে স্বাবলম্বী এবং কৃতজ্ঞ মানুষ করে দিলেন।

আরেকটি ঘটনা

আরেকটি ঘটনা। একবার একটি পাড়াগাঁয়ের ভিতর দিয়ে যাচ্ছেন বিদ্যাসাগর। একটি বাড়ি থেকে একটি মেয়ের খুব কান্না শুনলেন। ‘হয়েছে কী?’  জিজ্ঞেস করলেন একজন লোককে। লোকটি বলল, ‘মেয়েটির স্বামী মারা গিয়েছে। গহনাপত্র বিক্রি করে সর্বস্ব খরচ করে মেয়েটি স্বামীর চিকিৎসা করিয়েছে। এখন স্বামীর অভাবে মেয়েটির কী দুর্দশা হবে বুঝতেই পারছেন।’
বিদ্যাসাগর জিজ্ঞেস করলেন, ‘ওই স্বামীর কী নাম বলতে পারো?’ লোকটি নাম বলল, ‘রাম’।
বিদ্যাসাগর তখনি ‘রামদাদা, রামদাদা, বাড়ি আছ’ বলতে বলতে বাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়লেন। মেয়েটি কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘তিনি আর নেই গো।’
‘অ্যা, রামদাদা মারা গেছেন! তিনি আমাকে যে বড়ই বিপদে ফেলে গেছেন।’
শুনে আরও ভয় পেয়ে গেল মেয়েটি: ইনিও একজন পাওনাদার নাকি?
বিদ্যাসাগর তাড়াতাড়ি বললেন, ‘অনেক টাকা তিনি আমাকে দিয়ে গেছলেন। বিপদে পড়লে তিনি আমার কাছ থেকে চেয়ে নিবেন বলেছিলেন। তবে এখন যখন তিনি নেই তখন সেসব টাকা তোমাদের আমি একসঙ্গে দিব না। তোমাদের যখনি যা দরকার হবে আমার কাছ থেকে নেবে। আর মাসে মাসে আমি মাসহারা দেব।’ আহ্! কী মধুর মিথ্যা। এরকম মিথ্যা কার না ভালো লাগে।
কথায় বলে আপনি আচরি ধর্ম অপরে শেখাও। বিদ্যাসাগর যা বিশ্বাস করতেন তাই মানুষকে শিক্ষা দিতেন। নিজে করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতেন। তাই উপদেশ দিতে হলে তিনি এমনভাবে দিতেন যাতে মনে থাকে এবং সারাজীবন ধরে এমনটাই করে গেছেন তিনি। একদিন কার্মাটার রেলওয়ে স্টেশনে একজন বাঙালি ডাক্তারবাবু একটি ছোট ব্যাগ নিয়ে ট্রেন থেকে নেমে ‘কুলি কুলি’ বলে ডাকছেন। একজন সামান্য বেশধারী ব্যক্তি বাবুর ব্যাগটি তার হাত থেকে নিয়ে স্টেশনের বাইরে বাবুটির জন্য অপেক্ষমান পালকিতে তুলে দিলেন। তখন বাবু তাঁকে দুইটি পয়সা দিতে গেলেন। তখন ঐ ব্যক্তি একটু হেসে বললেন, ‘ক্ষুদ্র ব্যাগটি নিয়ে বড় বিপদে পড়েছিলেন বলে একটু সাহায্য করলাম; পারিশ্রমিক দিতে হবে না; আমার নাম ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর।’ বাবুটি লজ্জায় মৃতপ্রায় হয়ে বিদ্যাসাগরের পায়ে পড়লেন এবং বললেন, ‘লোকোপকার আপনার জীবনের ব্রত; আপনি দয়ারসাগর। আমার যে শিক্ষার প্রয়োজন ছিলো তা-ই আজ আমাকে দিলেন; নিজের কাজ নিজ হাতে করতে আর কখনো দ্বিধা করব না।’

বিদ্যাসাগরের আত্ম-মর্যাদাবোধ

বিদ্যাসাগরের আত্ম-মর্যাদাবোধ ছিল সাধারণের থেকে অনেক ঊর্ধ্বে। কোনো অবস্থাতেই তিনি কারো কাছে মাথা নত করতেন না। তিনি ছিলেন স্বাধীনচেতা। অহংকারী শাসক-গোষ্ঠীকেও তিনি তোয়াজ করে চলতেন না। নীতি আদর্শের ক্ষেত্রেও তিনি কখনো আপোস করেননি। এজন্য তিনি কয়েকবার চাকরিও ছেড়ে দিয়েছিলেন। তাঁর নীতি ছিল- বাঁচতে হলে মাথা উঁচু করেই বাঁচব। এজন্য ব্রিটিশ সরকার তাঁকে খুব সমীহের চোখে দেখত।এরকম একটা ঘটনা ১৮৪৬ সালের ৬ এপ্রিল বিদ্যাসাগর সংস্কৃত কলেজের অ্যাসিস্টেন্ট সেক্রেটারি হলেন। সেই সময় হিন্দু কলেজের প্রিন্সিপাল ছিলেন কার সাহেব। কী একটা কাজে বিদ্যাসাগর একদিন কার সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে গেছেন। কার সাহেব বিদ্যাসাগরকে আমল দিলেন না। একবার বসতে পর্যন্ত বললেন না। চেয়ারে হেলান দিয়ে টেবিলের উপর পা তুলে বসে রইলেন।
ব্রিটিশ শাসক প্রভুরা ভারতবাসীকে কথায় কথায় ‘অসভ্য’ আর নিজেদেরকে ‘সভ্য’ বলে বড়াই করত। উনিশ শতকের বাঙালি সমাজের সবচেয়ে সম্মানিত ব্যক্তিকে এভাবে জব্দ করতে পেরে কার সাহেব মনে মনে নিজের বাহাদুরীতে পরম তৃপ্তিবোধ করলেন। বিদ্যাসাগর ইংরেজ সাহেবের এই আচরণে মনে মনে রুষ্ট হলেন কিন্তু বাইরে কোনো চাঞ্চল্য প্রকাশ করলেন না। কাজের কথা শেষ করে বিদ্যাসাগর কার সাহেবের ঘর থেকে চুপচাপ চলে এলেন। কার সাহেব যে অভদ্র ব্যবহার করেছেন, সে বিষয়ে একটি কথাও বললেন না। কিন্তু অপমানটুকু ঠিক মনে রইল।
দিন কয়েক পরের কথা। কার সাহেব কী একটা কাজে বিদ্যাসাগরের কাছে এসে উপস্থিত। এই সুযোগ। কার সাহেব যেমন করেছিলেন, বিদ্যাসাগরও ঠিক তেমনি চেয়ারে হেলান দিয়ে টেবিলের উপর জুতাসহ পা তুলে বসে রইলেন। কার সাহেব বিদ্যাসাগরকে বসতে বলেননি, বিদ্যাসাগরও কার সাহেবকে বসতে বললেন না। কার সাহেবের বদনখানি তখন উঠের কাঁটাগাছ খাওয়ার মতো অবস্থা নাকি গ্যাসের চুলা বাস্ট হয়ে চোখ-মুখ ঝলসানোর মতো বিভৎস রূপ ধারণ করেছিল তা বলা কঠিন। তবে তিনি কাজ সেরে তাড়াতাড়ি সেখান থেকে চলে গেলেন। বিদ্যাসাগরের নামে নালিশ করলেন শিক্ষা-পরিষদের সম্পাদক ময়েট সাহেবের কাছে। ময়েট সাহেব বিদ্যাসাগরের কৈফিয়ৎ তলব করলেন।
বিদ্যাসাগর কৈফিয়ৎ দিলেন- ‘আমি ভেবেছিলাম আমরা অসভ্য, সাহেবরা সভ্য। সাহেবদের কাছেই আমাদের সভ্যতা শেখা উচিত। কার সাহেবের কাছে আমি যেমন অভ্যর্থনা পেয়েছিলাম, আমি ভেবেছিলাম, অভ্যর্থনা করার সেটাই বুঝি সভ্য রীতি। আমি তাই সেভাবেই কার সাহেবকে অভ্যর্থনা করেছি। এতে যদি আমার কোনো অপরাধ হয়ে থাকে তো সে অপরাধের জন্য স্বয়ং কার সাহেবই দায়ী।’
বিদ্যাসাগরের স্পষ্ট কথায় ময়েট সাহেব খুশি হয়েছেন। তারপর ময়েট সাহেবের কথায় কার সাহেব নিজেই বিদ্যাসাগরের সঙ্গে দেখা করে ব্যাপারটার একটা আপোস-নিষ্পত্তি করেছেন।
আর সব গুণীজনদের মতো কেবল তাঁর জীবনের দুই একটি ঘটনা জানার মধ্য দিয়ে বললে হবে না যে, এই হচ্ছে আমাদের বিদ্যাসাগর। বরং তাঁর ব্যক্তিত্ব, তাঁর পৌরুষ, তাঁর দৃঢ়তা, তাঁর প্রজ্ঞা, তাঁর উচ্চতর হৃদয়বৃত্তি তথা তাঁর কর্ম ও জীবন নিয়ে নিবিড় চর্চা করলে তবেই প্রকৃত বিদ্যাসাগরকে জানা সম্ভব।

 

তিনি বাঙালি জীবনে আদর্শস্থানীয় হয়ে আছেন। তাঁর সৃষ্ট গদ্যের পথ ধরে যেমন আজকের গদ্য ঐশ্বর্যশালী হয়েছে তেমনি তাঁর জীবন থেকে নির্যাস নিয়ে আজকের জীবনও ঐশ্বর্যশালী হতে পারে। সেই সময়ের প্রেক্ষাপটে তিনি বলেছিলেন, ‘পুরাতন প্রকৃতি ও প্রবৃত্তি বিশিষ্ট মানুষের চাষ উঠাইয়া দিয়া সাত পুরু মাটি তুলিয়া ফেলিয়া নতুন মানুষের চাষ করিতে পারিলে, তবে এদেশের ভালো হয়।’
তাঁর এ কথাটি আজও প্রাসঙ্গিক নয় কি?

Sharing is caring!

Dipankar Shil

দীপংকর শীল একজন অনুসন্ধানী লেখক ও গ‌বেষক। ‌তার প্রকা‌শিত গ্রন্থ "কুরুখ ভাষা শেখার প্রথম পাঠ" (২০২২), "উরাং জনগোষ্ঠীর কুরুখ ভাষা প‌রিচয় ও অ‌ভিধান" (২০২২)। তি‌নি বি‌ভিন্ন সা‌হিত্য প‌ত্রিকা সম্পাদনা ক‌রে‌ছেন। আন্তর্জা‌তিক জার্নাল সহ বি‌ভিন্ন পত্রপ‌ত্রিকায় তাঁর অ‌নেক প্রবন্ধ প্রকা‌শিত হ‌য়ে‌ছে। বর্তমা‌নে তিনি একটি সরকারি ক‌লে‌জে বাংলা বিভাগের প্রভাষক পদে দায়িত্ব পালন করছেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *