ঘটনাটি আজ থেকে প্রায় চারশত বছর আগের । ভারতে তখন প্রতাপশালী মুঘল সাম্রাজ্যের শাসন। মুঘল মসনদে সম্রাট হিসেবে অধিষ্ঠিত ছিলেন আবু মুজাফফর বিন মুহিউদ্দিন মুহাম্মদ আলমগীর। যাকে সবাই সম্রাট আওরঙ্গজেব নামে বেশি চিনি।
আওরঙ্গজেবের সম্পূর্ণ রাজকীয় নাম
তবে আওরঙ্গজেবের সম্পূর্ণ রাজকীয় নামটি কিন্তু বেশ বৃহৎ- ”আল-সুলতান আল-আজম ওয়াল খাকান আল-মুকাররম হযরত আবুল মুজাফফর মুই-উদ-দিন মুহাম্মদ আওরঙ্গজেব বাহাদুর আলমগীর প্রথম, বাদশা গাজি, শাহানশাহ-ই-সালতানাত-উল-হিন্দিয়া ওয়াল মুঘালিয়া”।
বাবর, হুমায়ুন, আকবর, জাহাঙ্গীর এবং শাহ জাহানের পরে আওঙ্গজেব ছিলেন ষষ্ঠ মুঘল সম্রাট। সম্রাট শাহজাহানের তৃতীয় পুত্র তিনি। সাম্রাজ্য পরিচালনায় তিনি যেমন তুখোড় ও দক্ষ ছিলেন তেমনি ধর্মের প্রতি ছিল তাঁর অগাধ ভালোবাসা ও প্রবল শ্রদ্ধা। ছিলেন একজন ধর্ম প্রাণ মুসলিম এবং কোরআন-এ হাফিজ। তাঁর আমলেই মূলত ভারতে মুঘল সাম্রাজ্যে ইসলামি হুকুমত কায়েম হয়। যার কোনো বিরূপ প্রভাব পড়েনি অন্য ধর্মাবলম্বীদের ওপর। মুঘল সাম্রাজ্যে তিনিই প্রথম মদ্যপান, জুয়া, খোজা করন, দাস ব্যবসা, মাদক ব্যবসা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করেছিলেন। সম্রাট হওয়া সত্ত্বেও তিনি সাধারণ জীবন যাপন করতেন। এমনকি তিনি টুপিতৈরি করে এবং নিজের হাতের লিখা কুরআন বিক্রি করে নিজের খরচ চালাতেন।
রাজ্যের কোষাগার থেকে সম্রাট আলমগীর কোন অর্থ নিজের জন্য নিতেন না। তাঁর আমলেই একীভূত ভারতের সীমানা সর্ব্বোচ পর্যায়ে পৌঁছেছিল। সৈন্যদের মনোবল বাড়াতে তিনি নিজে সর্বদা যুদ্ধে অংশ নিতেন ।
কান্দাহার দূর্গ যেভাবে দখলে এলো
একবার তিনি ও তার সৈন্যদল আফগানিস্থান অভিযানে যান। মূল উদ্দেশ্য ছিল গুরুত্বপূর্ণ কান্দাহার দুর্গ দখল। দূর্গের চারিদিক পরিবেষ্টিত করে মুঘল সৈন্যরা একের পর এক গোলাবারুদ ছুড়ছিল কান্দাহার দূর্গের দিকে । কান্দাহার দূর্গের বাদশাহ ছিলেন জুনায়েত আলী শাহ । তিনি ও তার সৈন্যদলও ছিল সুপ্রশিক্ষিত । তারাও যথেষ্ঠ দক্ষতার সাথে দূর্গ প্রতিরোধ করছিল । এদিকে মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবও ছিলেন নাছোড়বান্দা । তিনি এই দূর্গ জয় করে তবেই দিল্লী ফিরে যাবেন বলে প্রতিজ্ঞা করেছেন।
দিনব্যাপী যুদ্ধের এক পর্যায়ে মাগরিবের ওয়াক্ত হয়ে যায়। মুঘল ও আফগানিরা যখন গভীর যুদ্ধে লিপ্ত ঠিক তখনি মসজিদে মাগরিবের আজান পড়ল । সাথে সাথে বাদশাহ আলমগীর গভীর যুদ্ধের মধ্যেও নামাজের বিছানা বিছিয়ে নামাজে দাঁড়িয়ে গেলেন । আফগান বাদশাহ জুনায়েত শাহ দূর্গের উপর থেকে এ দৃশ্য দেখে তার সৈন্যদের হামলা বন্ধ করতে বললেন। সাথে সাথে মুঘল সৈন্যরা হামলা বন্ধ করে ফেলল। সবাই এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মুঘল সম্রাটের দিকে। এমনভাবে তিনি নামাজ পড়ছেন যেন নিজের ঘরে বসে একান্তে নামাজ পড়ছেন। এমনকি তার মনে চিন্তা নেই যে, তিনি এক যুদ্ধের ময়দানে আছেন।
নামাজ শেষে সালাম ফেরাতেই কান্দাহার দূর্গের প্রধার ফটক খুলে আফগান বাদশাহ জুনায়েত আলী দৌঁড়ে এসে মুঘল সম্রাট আলমগীরের সামনে বসেন । আফগান বাদশাহ তার হাতে হাত রেখে বলল, ’এ আমি কার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছি! এ যে খোদা ও তাঁর নবীর শান্তির বাণী নিয়ে আমার নিকটে এসেছে। এমন মুমিন খোদার বান্দার নিকট আমি শুধু কান্দাহার কেন পুরো আফগানিস্তান-ই সমর্পণ করছি। যতদিন আমি বেঁচে আছি যতদিন পর্যন্ত আফগানিস্তান মুঘল সাম্রাজ্যে অংশ হিসেবেই থাকবে।’
আর এভাবেই সম্রাট আলমগীরের ইসলাম ধর্মের প্রতি অসাধারণ আনুগত্যে অনুপ্রাণিত হয়ে আফগানিস্তান মোগল সাম্রাজ্যের অংশ হয়েছিল। যা এর আগে কখনো সম্ভব করতে পারেনি কোনো ভারতবর্ষের সুলতান। এমনকি যে বৃটিশরা ২০০ বছর ভারতবর্ষ শাসন করেছে তারাও। বৃটিশদের আমলে বারবর আফগানিস্তান তাদের হাতছাড়া হয়েছে। তারা পরাজিত হয়ে সেখান থেকে ফিরেছে।