রাজমহলের যুদ্ধ

বাংলার স্বাধীনতা রক্ষার অন‌ন্য এক যুদ্ধ : রাজমহলের যুদ্ধ

ইতিহাস নির্বাচিত পোস্ট
বাংলার ইতিহাসে রাজমহলের যুদ্ধ এক অনন্য গুরুত্ব বহন করে। যা ব‌্যাটল অফ রাজমহল নামে পরিচিত। এই যুদ্ধের ফলাফলে বাংলায় মুঘল শাসন প্রতিষ্ঠা লাভ করে। বাংলা শৃংখলিত হয় পরাধীনতার নাগপাশে।

 

১২০০ খ্রিস্টাব্দে ভারতীয় উপমহা‌দে‌শে মুসলমান‌দের আ‌ধিপত‌্য প্রতি‌ষ্ঠিত হয় । যার ম‌ধ্যে বে‌শিরভাগ আ‌ধিপত‌্যই প্রতি‌ষ্ঠিত হ‌য়ে‌ছে আফগা‌নি‌দের হাত ধ‌রে । প্রথম‌দি‌কে দি‌ল্লি‌তে তা‌দের আ‌ধিপত‌্য থাক‌লে সময়ের প‌রিক্রমায় তা‌দের আ‌ধিপত‌্য বাংলা‌কে‌ন্দ্রিক হ‌য়ে যায় । ১৪০০ খ্রিস্টাব্দে এ দে‌শে পা রা‌খে আফগা‌নি কররা‌নীরা । তারা এ দেশ‌কে আপন ক‌রে নি‌য়ে‌ছিল।
এই কররানী বংশের উত্থানের মাধ্যমে ১৫’ শত‌কে স্বাধীন কররানী সালতানাত প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে বাংলা তার হারানো স্বাধীনতা ফিরে পায়। এ বং‌শেরই অন‌্যতম সুলতান হচ্ছেন দাউদ খান কররানী । তার পূর্বপুরুষরা পূ‌র্বে মুঘল‌দের বশ‌্যতা স্বীকার ক‌রে নি‌লেও তি‌নি মুঘল‌দের অধীনতা অস্বীকার ক‌রে বিহার, বাংলা উড়িষ‌্যা‌কে নি‌য়ে নতুন বাংলা সাম্রা‌জ্যের ঘোষণা দেন । এমনকি তিনি দিল্লির প্রভুত্ব মেনে না নিয়ে নিজের নামে মুদ্রাঙ্কণ এবং খুতবা পাঠ করেন।

সুলতানী আমলের মুদ্রা;

                                                                          সুলতানী আমলের মুদ্রা; Image Source Coin India

বাংলা দখলে সম্রাট আকবরের সৈন্য প্রেরণ

তখন দি‌ল্লির সিংহাস‌নে ক্ষমতায় ছি‌লেন মুঘল সম্রাট আকবর । সম্রাট আকবর তাঁর নতুন ধর্ম দীন-ই-এলাহী প্রবর্তন কর‌লে বি‌শেষ ক‌রে মুসলীম ধর্মাবলম্বীদের অন্ত‌রে বিরাগভাজন হন। তাই তারা দাউদ খা‌নের স্বাধীনতা ঘোষণা‌কে সাধুবাদ জানান এবং তার পা‌শে থাকার কথা দেন ।
দাউদ খা‌নের স্বাধীনতা ঘোষণার খরব সম্রাট আকবর কা‌নে পৌছা‌লে তি‌নি প্রথ‌মে ১০ হাজার ও প‌রে ১৫‌ হাজার সৈন‌্য দিয়ে তাঁর সেনাপ‌তিদের বাংলা সালতানা‌তের তখনকার রাজধানী পান্ডুয়া দখল কর‌তে পাঠান । কিন্তু তারা দাউদ খা‌নের যুদ্ধ‌কৌশল ও দু‌র্ভেদ‌্য দুর্গ দখল কর‌তে ব্যর্থ হয় । ফলে ন‌ড়েচ‌ড়ে ব‌সেন সম্রাট‌। বি‌শেষ দৃষ্টি দেন বাংলার দি‌কে। আকবর বাংলা পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে সেনাপতি খান-ই-জাহান হোসেন কুলি বেগকে দায়িত্ব দেন। সম্রাটের নির্দেশে সেনাপতি কুলি বেগ ৩০ হাজার বিশাল সৈন‌্যদল ও ভয়ংকর অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে বাংলা দখ‌লে আসেন। অন্যদিকে দাউদ খানও প্রস্ত্তত ছিলেন এবং সেনাপতি কালাপাহাড়, জুনায়েদ ও কুতলু খানের সহযোগিতায় নিজের সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করেন। দাউদ খান তেলিয়াগড়িতে তিন হাজার সেরা আফগান সৈন্য সমবেত করেন এবং নিজে রাজমহলের পাহাড় ও গঙ্গার মধ্যবর্তী অপ্রশস্ত এলাকায় বাকি সৈন্য-সামন্তসহ অবস্থান নেন।

রাজমহলের যুদ্ধ

হোসেন কুলী বেগ তেলিয়াগড়িতে এসে আফগানদের মুখোমুখি হন। উভয়পক্ষে প্রচন্ড যুদ্ধ শুরু হয়। প্রায় অর্ধেক আফগান সৈন্য যুদ্ধে মারা যায়। ফলস্বরূপ তেলিয়াগড়ি হোসেন কুলী বেগের অধীন হয়। এরপর দাউদ খানকে মোকাবিলা করতে তিনি রাজমহলের উদ্দেশ্যে অগ্রসর হন।আফগানগরাও সংঘবদ্ধভাবে মুঘলদের প্রতিরোধ করে। এ সময় অবশ্য মুঘল শিবিরকে নানান বাধা-বিঘ্ন ও সমস্যা মোকাবিলা করতে হয়েছিল। বিশষ করে শিবিরে শিয়া-সুন্নী দ্বন্দ্ব, মৌসুমী জলবায়ুর আগমনে আবহাওয়া-সংক্রান্ত সমস্যা এবং সর্বোপরি খাদ্য ও অস্ত্র ঘাটতি মুঘল বাহিনীকে সংকটের মধ্যে ফেলে দিয়েছিল। এতদ সত্ত্বেও খান-ই-জাহান হোসেন কুলী বেগ প্রায় চার মাস রাজমহল অবরোধ করে রাখেন। খান জাহান আলী ছি‌লেন খুব চতুর । গোপ‌নে সে দাউদ খানের সেনাপ‌তি কুতলু খানকে লোভ দে‌খি‌য়ে নি‌জের দ‌লে ভি‌ড়ি‌য়ে নেন । দাউদ খা‌নের নির্বা‌চিত ও বিশ্বস্ত বিহা‌রের প্রতি‌নি‌ধি মুজাফফর খান‌কেও লোভ দেখি‌য়ে দ‌লে ভি‌ড়ি‌য়ে নেন । যারা পরবর্তিতে যুদ্ধে নিষ্ক্রিয় ছিল।
এরই মধ্যে সম্রাটের নির্দেশে বিহারের গভর্নর মোজাফ্ফর খান তুরবতি পাঁচ হাজার ঘোড়-সওয়ার এবং নৌকা বোঝাই খাদ্য ও গোলাবারুদ নিয়ে খান-ই-জাহানের সহায়তায় রাজমহলে উপস্থিত হন। এরপর এই বর্ধিত শক্তি নিয়ে মুঘলরা ১৫৭৬ খ্রিস্টাব্দের ১২ জুলাই (১৫ রবি-উস-সানি, ৯৮৪ হিজরি) রাজমহলে আফগানদের মুখোমুখি হয়।
মুঘলদের এই সম্মিলিত বাহিনীর সাথে কররানীদের প্রচন্ড যুদ্ধ সংঘটিত হয়। দাউদ খান নিজে সৈন্যবাহিনীর মধ্যভাগ, জুনায়েদ বাম অংশ এবং কালাপাহাড় ডান দিকের নেতৃত্ব দেন। অগ্রভাগের নেতৃত্বে থাকেন কুতলু খান। অবশ্য বিশ্বাসঘাতক সেনাপ‌তি কুতলু খান যু‌দ্ধের ময়দা‌নে ‌নিরব দর্শকের ভূ‌মিকা নিয়েছিল। যুদ্ধে কামানের গোলার আঘাতে জুনায়েদ নিহত হন। জুনায়েদের মৃত্যু দাউদ বাহিনীর মনোবল ভেঙ্গে দেয় এবং তারা যুদ্ধক্ষেত্র ছেড়ে পালিয়ে যায়।
কালাপাহাড় এবং কুতলু খান পালিয়ে যেতে সক্ষম হলেও, দাউদ খানের ঘোড়া কাদায় আটকে যাওয়াতে তিনি ধরা পড়েন ও বন্দি হন। সমস্ত অরাজকতা ও বিদ্রোহের জন্য দয়ী করা হয় দাউদ খানকে। তাই খান-ই-জাহান দ্রুক তার মৃত্যুদন্ড দ্রুত কার্যকর করার আদেশ দেন। ফ‌লে তা‌কে নৃশংসভা‌বে ১৫৭৬ সা‌লে রাজমহ‌লের ময়দা‌নে ফাঁসি‌তে ঝু‌লিয়ে হত‌্যা করা হয় দাউদ খানকে।

 

এভাবে কররানী রাজবংশের পতনের ফলে বাংলা সালতানাতের সমাপ্তি ঘটে এবং বাংলা মুঘল সাম্রাজ্যের একটি সুবা বা প্রদেশে পরিণত হয়। বাংলা হারায় তার ২০০ বছ‌রের স্বাধীনতা । সম‌য়ের প‌রিক্রমায় আমরা ভু‌লে গি‌য়ে‌ছি এসব ইতিহাস।

Sharing is caring!

Rubel Ahmad

রুবেল আহমেদ একজন কবি ও কনটেন্ট রাইটার হিসেবে পরিচিত। ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে পড়াশুনা করছেন।

2 thoughts on “বাংলার স্বাধীনতা রক্ষার অন‌ন্য এক যুদ্ধ : রাজমহলের যুদ্ধ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *