সনাতন হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা পাপ মোচনের বাসনায় প্রতিবছর চৈত্র মাসের অষ্টমী তিথিতে লাঙ্গলবন্দের ব্রহ্মপুত্র নদের জলে স্নান করেন। এই লাঙ্গলবন্দ অষ্টমী স্নান সম্পর্কে একটি দীর্ঘ পৌরাণিক কাহিনী প্রচলিত আছে।
হিন্দু পুরান মতে, ত্রেতাযুগের সূচনাকালে মগধ রাজ্যে ভাগীরথীর উপনদী কৌশিকীর তীর ঘেঁষে এক সমৃদ্ধ নগরী ছিল, যার নাম ভোজকোট। এ নগরীতে ঋষি জমদগ্নি ও তার রাজবংশীয় পরমাসুন্দরী স্ত্রী রেণুকার পাঁচ সন্তানের মধ্যে পরশুরাম ছিলেন কনিষ্ঠ। হিন্দু পুরাণে যে কজন অমরত্বের অধিকারী তাদের মধ্যে সবচেয়ে আকর্ষণীয় ও বৈচিত্রময় চরিত্র হলেন পরশুরাম। পরশুরাম এমনই একটি চরিত্র, যিনি রামায়ণ এবং মহাভারত— দুই মহাকাব্যেই উপস্থিত। তিনি বিষ্ণুর দশ অবতারের মধ্যে ষষ্ঠ। উদ্ধত ক্ষত্রিয়দের হাত থেকে ব্রাহ্মণদের রক্ষা করার জন্য বিষ্ণু পরশুরাম হিসাবে পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তপস্যা দ্বারা তিনি মহাদেবকে তুষ্ট করে পরশু অর্থাৎ কুঠার অস্ত্রটি লাভ করেছিলেন। তাই তার নাম হয় পরশুরাম।
পরশুরামের মাতৃহত্যা ও পাপমুক্তি
একদিন ঋষি জমদগ্নি যজ্ঞের আয়োজনে ব্যস্ত সময় পার করছিলেন। সে সময় তার স্ত্রী, পরশুরামের মা রেণুকা জল আনতে গিয়েছিলেন পাশ্ববর্তী নদীতে। একই সময় সেই নদীতে পদ্মমালী (মতান্তরে চিত্ররথ) নামক গন্ধবরাজ স্ত্রীসহ জলবিহার করছিলেন (মতান্তরে অপ্সরী গণসহ)। পদ্মমালীর রূপ এবং তাদের সমবেত জলবিহারের দৃশ্য রেণুকাকে এমনভাবে মোহিত করে যে, তিনি তন্ময় হয়ে সেদিকে তাকিয়ে থাকেন। রেণুকা কামার্তা হয়ে পড়েন ও নিজের পূর্ব-রাজকীয় জীবন সম্পর্কে স্মৃতিবিষ্ট হন। এদিকে ঋষি জমদগ্নি বহুক্ষণ ধরে তার স্ত্রীর গৃহে ফেরার অপেক্ষা করছিলেন। রেণুকা তখনও কুটিরে ফিরে না আসায় চিন্তিত ঋষি ধ্যানযোগে স্ত্রীর ওই অবস্থা দেখে অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হন। তিনি তৎক্ষণাৎ পুত্রদেরকে মাতৃহত্যার আদেশ দেন। কিন্তু মাতৃহত্যা যে মহাপাপ! এ জন্য ঋষি জমদগ্নি-র প্রথম চার সন্তানই পিতার এ আদেশ পালন করতে রাজি হননি। তখন ঋষি তার চার সন্তানকে জড়ত্বের অভিশাপ দেন। শেষে ঋষি তার কনিষ্ঠ সন্তান পরশুরামকে একই আদেশ দিলে পরশুরাম তার কুঠার দিয়ে মায়ের শিরশ্ছেদ করে বসেন।
মাকে হত্যা করে পরশুরাম পরম পাপী হিসেবে চিহ্নিত হন। পাপের শাস্তি হিসেবে কুঠারটি তার হাতে আটকে থাকে। শত চেষ্টা করেও তা থেকে তিনি মুক্ত হতে পারলেন না। পিতার কাছে এর কারণ জানতে চাইলে পিতা বলেন, ‘তুমি মাতৃহত্যা আর নারীহত্যা এই দ্বিবিধ পাপেই আক্রান্ত হয়েছো। আর জেনে রেখো, পাপ ছোট বা বড় যা-ই হোক না কেন কৃতকর্মীকে তা স্পর্শ করবেই।’ তখন পরিত্রাণের উপায় জানতে চাইলে পিতা জমদগ্নি পুত্রকে আশ্বস্ত করে তীর্থ পরিভ্রমণের উপদেশ দিয়ে বলেন, ‘যে তীর্থ গমনে বা স্নানে তোমার হাতের কুঠার স্খলিত হবে, জানবে যে ঐ পুণ্যস্থানই পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ তীর্থক্ষেত্র।’ তখন পিতৃ আজ্ঞায় পরশুরাম তীর্থ পরিভ্রমণে বের হন। মাতৃহত্যার ভয়াবহ পাপের অনুশোচনা নিয়ে তিনি তীর্থ থেকে তীর্থে ঘুরে বেড়াতে লাগলেন।
দেবতা ব্রহ্মপুত্র তখন হিমালয়ের বুকে হ্রদরূপে লুকিয়ে ছিলেন। এই ব্রহ্মপুত্র নদের নামকরণ হওয়ার পেছনে মূল কারণ হল ব্রহ্মার এক ছেলে অভিসপ্ত হয়ে এই নদ রুপ ধারণ করেছিল। আর তার নদী জীবন সার্থক এবং মানব কল্যাণে লাগানোর জন্য ভগবান শিব তাকেই বেছে নিয়েছিলেন। দৈবক্রমে পরশুরাম ব্রহ্মপুত্রের এই মাহাত্ম্যের কথা জানতে পারেন। তিনি খুঁজে পেলেন হিমালয়ে লুক্কায়িত ব্রহ্মপুত্র হ্রদ এবং প্রার্থনা জানালেন যেন এর পবিত্র জলে তার পাপ মুক্ত হয়। তারপর হ্রদের জলে ঝাঁপ দেওয়ার সাথে সাথে তার হাতে আটকে থাকা কুঠারখানা খসে পড়ে। তিথিটি ছিল চৈত্র মাসের শুক্লা অষ্টমী তিথি, বুধবার ও পুনর্বসু নক্ষত্র। এভাবে তিনি মাতৃহত্যার প্রায়শ্চিত্ত থেকে মুক্ত হন।
লাঙ্গলবন্দ নামকরণের কারণ
পরে ব্রহ্মপুত্রের এই অলৌকিক শক্তিসম্পন্ন পাপহরণকারী জল যাতে মানবকল্যাণে আসে সে উদ্দেশ্যে পরশুরাম সেই জলধারাকে সমতল ভূমিতে নিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নেন। এই অভিপ্রায়ে তিনি কুঠারখানা লাঙলের ফলকে বেঁধে সেই ফলক দিয়ে নালা সৃষ্টি করে ব্রহ্মপুত্রের পবিত্র জলধারাকে হিমালয়ের পাদদেশ পর্যন্ত আনতে সক্ষম হন।
তারপর লাঙ্গল দিয়ে মাটি কর্ষণ করে হিমালয়ের পাদদেশ থেকে ব্রহ্মপুত্রের জলধারাকে দীর্ঘ সময় ও পথ পরিক্রমায় পাহাড়-পর্বত পেরিয়ে তিনি বিভিন্ন জনপদ ঘুরিয়ে অবশেষে বর্তমান বাংলাদেশের নারায়ণগঞ্জ জেলার বন্দর থানার ‘লাঙ্গলবন্দ’ পর্যন্ত নিয়ে আসেন। সুদূর হিমালয় থেকে একাদিক্রমে হাল চালনায় ক্লান্ত হয়ে বিশ্রাম করার জন্য তিনি লাঙ্গলবন্দে এসে ক্লান্ত হয়ে থেমে যান এবং লাঙল চষা বন্ধ করে দেন। যেখানে লাঙ্গল বন্ধ রেখেছিলেন সেই থেকে সে স্থানের নাম হয় ‘লাঙ্গলবন্দ’ এবং ব্রহ্মপুত্র নদের পাড়ের লাঙ্গলবন্দ হয়ে ওঠে হিন্দুধর্মের মানুষের জন্য পরম পুণ্যস্থান। আর তার লাঙলের ফলকে তৈরি পথ ধরে ব্রহ্মপুত্র প্রবাহিত হতে থাকে নিরবধি।
1 thought on “লাঙ্গলবন্দ অষ্টমী স্নান ও একটি মিথ”