মার্ক টোয়েন এর ছোট গল্প
একটি উপকথা
(A Fable)মূল লেখক : মার্ক টোয়েন
ভাষান্তর: শাহ্জাহান মানিক
একদা একজন চিত্রশিল্পী একটি দারুন সুন্দর ছোট ছবি এঁকেছিল। তারপর সেটাকে এমনভাবে স্থাপন করে রাখলেন যাতে আয়নায় চেয়ে ছবিটা দেখতে পাওয়া যায়। “এটা দূরত্বটাকে দ্বিগুণ বাড়িয়ে ছবিটা আরো মায়াবী করে তুলল এবং ছবিটা আগের চেয়ে দ্বিগুন মনোরম দেখাল।”
শিল্পীর বাড়ির পোষা বিড়ালটির মুখে বনের সব পশুরা এ কথা শুনল। তারা ঐ বিড়ালটিকে খুব প্রশংসার চোখে দেখত। কারণ বিড়ালটি ছিল শিক্ষিত, মার্জিত রুচির ও সভ্য। তাদের সে এমন অনেক কিছু বলত যা এর আগে তাদের জানা ছিল না বা জানলেও সে সম্পর্কে নিশ্চিত ছিল না। এবার তারা বিড়ালের মুখে আয়নার ছবিটির সম্পর্কে নতুন গল্প শুনে খুব উৎসুক হয়ে উঠল। বিষয়টা ভালভাবে বুঝার জন্য এ সম্পর্কে নানারকম প্রশ্ন করতে শুরু করল। তারা যখন জিজ্ঞেস করল ছবিটা জিনিসটা কি তখন বিড়াল বিষয়টা তাদের বুঝিয়ে বলল সবিস্তারে।
“ওটা একটি সমতল জিনিস,” সে বলল, “চমৎকার রকমের সমতল, আশ্চর্য রকমের সমতল, এর সমতলত্ব দেখে মুগ্ধ হতে হয়; আর যে কি সুন্দর!”
এই কথা বনের পশুদের উত্তেজনার মাত্রাকে বাড়িয়ে দিল। তারা বলল, পৃথিবীর বিনিময়েও হলেও তারা ছবিটি দেখবে। তখন ভালুক জিজ্ঞেস করল,
“কি এমন যা ছবিটাকে এতো সুন্দর করল?”
“ছবিটা দেখতেই সুন্দর বলে,” বিড়াল জবাবে বলল।
এই উত্তর শুনে পশুদের মনের আকর্ষণ ও অনিশ্চয়তা আরও বেড়ে যায়। তারা আগের চাইতেও বেশী উত্তেজিত হয়ে পড়ে। তখন গরু প্রশ্ন করল:
“আয়না কাকে বলে?”
“আয়না হলো দেয়ালের মধ্যে একটি গর্ত,” জবাবে বিড়াল জানায়। “তুমি যদি তার দিকে তাকও তাহলেই ছবিটা দেখতে পাবে, আর সে ছবি এতো সুন্দর, এতো সূক্ষ্ম, এতো স্বর্গীয় যে তার কল্পনাতীত সৌন্দর্র্য তোমাকে এতোটাই অনুপ্রাণিত করবে যার ফলে তোমার মাথা ঘুরতে থাকবে, অতি-আনন্দে তুমি মূর্ছা যাবে।”
গাধা এতোক্ষণ ধরে একটি কথাও বলেনি; এবার সে এ বিষয়টায় একটু সন্দেহ প্রকাশ করতে আরম্ভ করল। সে বলল, এতো সুন্দর কোন জিনিস এর আগেও ছিল না এবং আজও নেই। তার মতে, কোন জিনিসের সৌন্দর্যের বিষয়ে যখন বিরাট বিরাট বিশেষণ যোগ করে অতিরঞ্জিত করা হয় তখন সে সৌন্দর্যের ব্যাপারে সন্দেহের অবকাশ থেকে যায়।
স্বাভাবিকভাবে এই সন্দেহ পশুদের মধ্যে একটি বিরুপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করল। আর তাতে বিড়ালটি অসন্তুষ্ট হয়ে চলে গেল। দিন ক’য়েকের মধ্যে এ বিষয়ে কেউ কোন আর উচ্চ-বাচ্য করল না। কিন্তু পরে আবার নতুন করে উৎসাহ দেখা দেয় এবং সকলের আগ্রহ স্পষ্টত: চোখে পড়ল। তারা তখন গাধাটাকে খুব বকাঝকা করল। কারণ সে বিনা প্রমাণেই ছবিটা সুন্দর নয় বলে সন্দেহ প্রকাশ করে তাদের এতো বড় একটা সম্ভাবনাময় আনন্দকে নষ্ট করে দিয়েছে। গাধাটা কিন্তু এতো কিছুর পরও বিচলিত হল না। সে তখন তাদের বলল, তার আর বিড়ালের মধ্যে কে সঠিক সেটা প্রমাণ করার একটি মাত্রই উপায় আছে: সে নিজে সেখানে গিয়ে গর্তটা দেখে এসে বলবে সে কি দেখেছে। পশুরা তখন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল আর খুশি হয়ে গাধাকে তখনই সেখানে যেতে বলেÑ গাধাও তাদের কথামত কাজ করল।
কিন্তু সে জানত না ঠিক কোথায় দাঁড়াতে হবে। ফলে সে ভুল করে আয়না আর ছবিটার মাঝখানে গিয়ে দাঁড়ায়। ফলাফলে আয়নার ছবিটা দেখাই গেল না। গাধাটা ফিরে এসে তখন জানাল:
“বিড়াল মিথ্যে বলেছে। ঐ গর্তে একটা গাধা ছাড়া আর কিছুই দেখা যায়নি। সমতল কোন জিনিসের চিহ্নমাত্র সেখানে চোখে পড়েনি। সেটা খুব সুন্দর আর ভাল গাধা, তবুও সেটা শুধু একটা গাধা ছাড়া আর কিছুই নয়।”
হাতি জিজ্ঞাসা করল:
“তুমি কাছে গিয়ে ভাল করে দেখেছিলে তো?”
“ওহে হাতি, পশুরাজ, খুব কাছ গিয়ে পরিষ্কারভাবে দেখেছি। আমি এতো কাছে গিয়ে দেখিছিলাম যে, আমার নাকটা আয়নাটাতে লেগে গিয়েছিল।”
“অদ্ভুত তো,” হাতি বলল, “যতোদূর জানি- বিড়ালটা সব সময় আমাদের সত্যি কথাই বলে। বরং এর চেয়ে আরো একজন স্বাক্ষী পাঠিয়ে দেখা যাক। ভালুক, তুমি বরং যাও, গর্তটা দেখ, তারপর ফিরে এসে জানও কি দেখলে।”
তাই ভালুক সেখানে গেল। ফিরে এসে বলল:
“বিড়াল আর গাধা দু’জনেই মিথ্যে কথা বলেছে। গর্তে একটা ভালুক ছাড়া আর কিছু নেই।”
পশুরা তো এবার অবাক হয়ে মহা ধাঁধায় পড়ে গেল। প্রত্যেকেই তখন নিজে গিয়ে দেখতে চাইল আসল ব্যাপারটা কি। হাতিও তাদের এক এক করে পাঠাতে লাগল।
প্রথমে গেল গরু। সে গর্তে একটি গরু ছাড়া আর কিছুই দেখতে পেল না।
বাঘ একটা বাঘ ছাড়া আর কিছু খুঁজে পেল না।
সিংহ, একটা সিংহ ছাড়া আর কিছুই দেখল না।
চিতা দেখতে পেল শুধুই চিতাবাঘ।
উটও দেখল একটা উট, এর বাইরে আর কিছু না।
হাতি তখন ভীষণ রেগে গেল। এবং বলল, সে নিজেই গিয়ে প্রকৃত সত্যটা জেনে আসবে। যখন ফিরে এলো, এসে সমস্ত প্রজাদের সে মিথ্যে কথা বলবার জন্য তিরস্কার করল। এবং বিড়ালের নৈতিক ও মানসিক অন্ধত্বের জন্য এমন রেগে গেল। তাকে আর শান্ত করা গেল না। সে বলল, “একমাত্র কানা ছাড়া সকলেই ঐ গর্তে একটা হাতির বাইরে আর কিছুই দেখতে পাবে না।”
নীতিকথা, বিড়াল কর্তৃক
যদি তুমি তোমার কল্পনার আয়না এবং বাস্তবের মধ্যে দাঁড়াও তাহলে তুমি যা কিছু সঙ্গে নেবে তাই সেখানে দেখতে পাবে। তুমি হয়তো তোমার কান দু’টো সেখানে দেখতে পাবে না, তবু জানবে কান দু’টো সেখানেই রয়েছে।