ব্রাহ্মসমাজ আন্দোলনের প্রথম প্রবক্তা হচ্ছেন রাজা রামমোহন রায় (১৭৭২ খ্রি.- ১৮৩৩ খ্রি.)। যদিও তিনি নিজে ব্রাহ্মণ ছিলেন তারপরও তিনি ছিলেন রাহ্মণ্যবাদের বিরুদ্ধে । কেননা হিন্দু সমাজে ব্রাহ্মণরাই জাতিপ্রথা বা জাতিবিভেদ তৈরি করেছিল। ধর্মের সকল সুবিধা তারাই ভোগ করতো। রাজা রামমোহন রায় এর প্রতিবাদ করেছিলেন। তাই হিন্দুধর্ম সংস্কারক রাজা রামমোহন রায় ও তাঁর বন্ধুবর্গ মিলে এক সাবর্জনীন উপাসনার মাধ্যমে ব্রাহ্মসমাজ শুরু করেন। তাঁদের উপাস্য ছিল ”নিরাকার ব্রহ্ম” আর তা থেকেই নিজেদের ধর্মের নাম রাখেন ব্রাহ্ম। যুক্তিবাদের প্রয়োগের উপর অধিক গুরুত্ব আরোপ করে রাজা রামমোহন রায় হিন্দু ধর্ম ও সামাজিক রীতিনীতিগুলি সংস্কারে উদ্যোগী হয়েছিলেন। তিনি নিজে একেশ্বরবাদী ধর্ম ও আধুনিক বিজ্ঞানের দ্বারা অনুপ্রাণিত হন। ব্রাহ্মধর্মের অনুগামীরা ‘ব্রাহ্ম’ নামে পরিচিত।
ব্রাহ্মসভা (পরবর্তিতে ব্রাহ্মসমাজ) হচ্ছে ১৯ শতকে স্থাপিত এক সামাজিক ও ধর্মীয় আন্দোলন যা ভারতবর্ষের সনাতন হিন্দু সমাজে পূনর্জাগরণের পুরোধা হিসেবে পরিচিত।
রামমোহনের ধর্মীয় সত্য অনুসন্ধানের তৃষ্ণা তাঁর উদার মানসিকতা তাঁকে সকল গুরুত্বপূর্ণ ধর্মের শাস্ত্রসমূহ অধ্যয়নে অনুপ্রাণিত করে। এভাবে তিনি শুধু সংস্কৃত ভাষায় হিন্দু ধর্মশাস্ত্রসমূহ, যেমন: বেদ অধ্যয়ন করেই ক্ষান্ত হন নি, তিনি হিব্রু ও গ্রিক ভাষায় বাইবেল এবং এমন কি আরবি ভাষায় কোরআনও অধ্যয়ন করেন।
প্রতিটি ধর্মের মূলনীতিগুলি পাঠ করে তিনি এ সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, প্রতিটি ধর্মের উদ্দেশ্যই এক। তা হল, মানবজাতির নৈতিক পুনর্জাগরণ। তাই তিনি মনে করলেন প্রতিটি ধর্মের নীতিগুলি পরিবর্তিত যুগের পরিপ্রেক্ষিতে ব্যাখ্যা ও পুনরায় পরীক্ষা করে দেখা প্রয়োজন। তিনি সিদ্ধান্ত নেন প্রতিটি ধর্মের বিশ্বজনীন নীতিশিক্ষাগুলি নিয়ে এবং সংশ্লিষ্ট ধর্মের গোঁড়ামি, আনুষ্ঠানিকতা ও কুসংস্কারগুলি বাদ দিয়ে সার্বজনীন নৈতিক উপদেশাবলি গ্রহণ করবেন। তিনি ভেবে দেখেছিলেন এজন্যে হিন্দুধর্ম পরিত্যাগ করে অন্য কোনো ধর্ম গ্রহণ করার আবশ্যকতা নেই। কিছুদিন অনেকটা অন্ধের মতো অনুন্ধানের পর ১৮২৮ সাল নাগাদ তাঁর ধর্মীয় ধ্যান-ধারণা কিছুটা স্পষ্ট রূপ লাভ করে।এভাবে আগস্ট ২০, ১৮২৮ সালে কলকাতায় তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে ব্রাহ্ম সভা (পরবর্তীসময়ে ব্রাহ্ম সমাজ) অর্থাৎ ঈশ্বরের সমাজ প্রতিষ্ঠা করেন। এ নব প্রতিষ্ঠিত সমাজের তাত্ত্বিক দাবি ছিল যে, এটাকে সাবর্জনীন ধর্ম হিসেবে বিবেচনা করতে হবে।
যদিও রাজা রামমোহন রায়ের ধর্মবিশ্বাস ছিল অনেকটা সম্রাট অকবরের ‘দ্বীনে এলাহী’র চিন্তা-চেতনার মতো- সকল ধর্মের সমন্বয়ের পক্ষে, তবুও এটা হিন্দুধর্মের একটি শাখায় পরিণত হয় এবং অদ্যবদি সেভাবেই বিরাজমান। এ নতুন ধর্মবিশ্বাসের ধর্মীয় মতবাদসমূহ ব্রাহ্ম সমাজের ট্রাস্টের দলিলে লিপিবদ্ধ আছে।