লেডি উইথ দি ল্যাম্প: ফ্লোরেন্স নাইটিংগেল

লেডি উইথ দি ল্যাম্প: ফ্লোরেন্স নাইটিংগেল

জানা অজানা নির্বাচিত পোস্ট
‘লেডি উইথ দি ল্যাম্প’ বলতে যে মহিয়সী মানবীর কথা শ্রদ্ধাভরে পৃথিবীর মানুষের স্মরণে আসে তিনি হচ্ছেন আধুনিক নার্সিংয়ের প্রবক্তা ফ্লোরেন্স নাইটিংগেল।
১৮২০ সালের ১২ মে এক অভিজাত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন ফ্লোরেন্স নাইটিংগেল। তাঁর বাবা উইলিয়াম এডওয়ার্ড নাইটিংগেল এবং মা ফ্রান্সিস নাইটিংগেল।
নাইটিংগেল তাঁর হৃদয়ে মানবসেবার প্রতি প্রথম টান অনুভব করেন ১৭ বছর বয়সে লন্ডনে থাকা অবস্থায়। পরবর্তীতে এই টানকে তিনি ‘ঈশ্বরের ডাক’ বলে অভিহিত করেছিলেন। কিন্তু সেবাকে তার নিজের জীবনের ব্রত হিসাবে নেয়ার কথায় প্রবল আপত্তি আসে তাঁর পরিবার থেকে। তখন সমাজে নার্সিং ছিল নিম্নবিত্ত, অসহায়, বিধবা মহিলাদের পেশা। পরিবারের প্রবল আপত্তি, বিশেষ করে মা ও বোনের তীব্র রাগ আর হতাশাকে মাড়িয়ে, সমাজে মেয়েদের ভূমিকা শুধু মা ও স্ত্রী হওয়ার মধ্যে আটকে থাকবে- এই নিয়মের বিরুদ্ধে গিয়ে, সমাজের ধনী, সুন্দরী, তরুণী ব্রিটিশ মেয়ের সামনের সমস্ত লোভনীয় হাতছানি আর প্রতিবন্ধকতার সামনে দাঁড়িয়ে শুধুমাত্র নিজের স্বাধীন ইচ্ছাশক্তির জোরে তিনি নিজেকে নার্সিংয়ের কৌশল ও জ্ঞানে দক্ষ করে তুলতে শুরু করেন।

 

নাইটিঙ্গেল (১৮২০-১৯১০)-এর ছিল অসামান্য গাণিতিক প্রতিভা। তিনিই প্রথম স্বাস্থ্যকর্মী যিনি পরিসংখ্যানকে কাজে লাগিয়ে দেখিয়েছিলেন সংক্রমণ কমাতে পারলে স্বাস্থ্য সংক্রান্ত বিষয়ের উন্নতি ঘটে। তাঁর গোটা কর্মজীবন জুড়ে তিনি যে বিষয়টির উপর জোর দিয়েছিলেন, তা আজও গুরুত্বপূর্ণ- হাত ধোয়া এবং সারা দেশে এবং বাইরে হাত ধোয়াসহ অন্যান্য স্বাস্থ্যকর অভ্যাস চালু করেন তিনি।

যেভাবে ফ্লোরেন্স নাইটিংগেল হলেন লেডি উইথ দি ল্যাম্প

নাইটিংগেলের সবচেয়ে বড় অবদান ছিল ক্রিমিয়ার যুদ্ধে অসুস্থ সৈন্যদের পাশে দাঁড়ানো। রাশিয়ার বিরুদ্ধে ইংল্যান্ডের এই যুদ্ধে বিপন্ন সৈন্যদের অবস্থা দেশে এসে বর্ণনা করেন টাইমস ম্যাগাজিনের একজন সাংবাদিক। সংবাদপত্রের এই ভাষ্যে দেশজুড়ে প্রতিক্রিয়া দেখা দিল। বিচলিত হয়ে উঠলেন সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মচারীরা। ক্রিমিয়ার যুদ্ধ (১৮৫৪-৫৬)-র সময়ে সরকার নার্স আহ্বান করে, দেশের এই ডাক নাইটিংগেল উপেক্ষা করতে পারেননি। নিজ উদ্যোগে নার্সিংয়ের জন্য ৩৮ জনের স্বেচ্ছাসেবী দল গঠন করে রওনা দিলেন স্কুটারির দিকে (স্কুটারি একটি জায়গার নাম যা বর্তমানে ইস্তানবুলে অবস্থিত), যেখানে আহত ব্রিটিশ সৈন্যদের জন্য গড়ে উঠেছে অস্থায়ী হাসপাতাল।
সেখানেই তিনি ‘লেডি উইথ দি ল্যাম্প’ খেতাব অর্জন করেন, কারণ তিনি রাতের বেলা একটি লন্ঠন হাতে রোগীদের শয্যার পাশে ঘুরে বেড়াতেন। তিনি রাতের বেলা এভোবে লন্ঠন হাতে যখন আহত সৈন্যদের কাছে যেতেন তখন তাঁকে কাছে পেয়ে সবার মনোবল বেড়ে যেতো। এমনকি একটা মিথ পর্যন্ত তৈরি হয়েছিল যে নাইটিংগেল যদি কারো মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় তাহলে নিশ্চিত সে সূস্থ হয়ে যাবে।

মানব সেবার জন্য বিয়ে ও সংসার পর্যন্ত করেননি ফ্লোরেন্স নাইটিংগেল

ব্যক্তিগত জীবনে ফ্লোরেন্স ঘর-সংসার করেননি, তিনি ভেবেছিলেন সেদিকে মনোযোগ দিলে তা তাঁর জীবনের লক্ষ্য অর্জনের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াবে। তাই অপূর্ব সুন্দরী সেই তরুণী সমাজের সবচেয়ে ধনী ও যোগ্য পাত্রদের মধ্যে অনেকের লোভনীয় বিয়ের প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন। সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল ধনী রাজনীতিবিদ ও কবি রিচার্ড মোঙ্কটন মিলন্সের সাথে ৯ বছরের বাগদানের পরও বিয়ে না করা। ফ্লোরেন্স বলেছিলেন বিয়ে ও সংসার নার্সিংয়ের জন্য তাঁর কার্যক্ষমতাকে সীমাবদ্ধ করে দেবে।

‘ইন্টারন্যাশনাল নার্সেস ডে’ ও ফ্লোরেন্স নাইটিংগেল

তিনি অসংখ্য পদক আর উপাধিতে ভূষিত হয়েছেন। ১৮৮৩ সালে রাণী ভিক্টোরিয়া তাকে ‘রয়েল রেডক্রস’ পদক প্রদান করেন। প্রথম নারী হিসাবে ‘অর্ডার অব মেরিট’ খেতাব লাভ করেন ১৯০৭ সালে। ১৯০৮ সালে লাভ করেন লন্ডন নগরীর ‘অনারারি ফ্রিডম’ উপাধি। এ ছাড়াও ১৯৭৪ সাল থেকে তার জন্মদিন ১২ মে পালিত হয়ে আসছে ‘ইন্টারন্যাশনাল নার্সেস ডে’। যার মধ্যেমে সম্মান জানানো হয় এক নারীকে যিনি তার কর্মের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা করেছেন- নার্সিং একটি পেশা নয় সেবা।
১৯১০ সালের ১৩ আগস্ট এই মহিয়সী নারী ৯০ বছর বয়সে লন্ডনে নিজ বাসভবনে মৃত্যুবরণ করেন যাত্রী ফ্লোরেন্স নাইটিংগেল। তাঁর শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী তাঁর পরিবার সরকার থেকে প্রস্তাবিত রাষ্ট্রীয় শেষকৃত্য অনুষ্ঠান প্রত্যাখান করে খুবই সাধারণভাবে চার্চের পাশে তাঁকে সমাহিত করে। তাঁর কর্মজীবনের স্বীকৃতি স্বরূপ ইস্তাম্বুলে চারটি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করা হয় তাঁর নামে।

Sharing is caring!

Shajahan Manik

ইংরেজি প্রভাষক শাহ্জাহান মানিক একাধারে কবি, লেখক, গবেষক ও অনুবাদক। একাধিক কাব্যগ্রন্থ ছাড়াও তার অনুদিত বইয়ের সংখ্যা ১০টি। এছাড়া সায়েন্স ফিকশন, সম্পাদনা, ছোটদের বইয়ের পাশাপাশি তার রয়েছে ইংরেজি শেখার বই। তার সর্বশেষ প্রকাশিত গ্রন্থ হচ্ছে- মানব কল্যাণে মুসলিম বিজ্ঞানীদের অবদান।

https://besorgo.com

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *