পৃথিবীর প্রথম গোয়েন্দা কাহিনি

পৃথিবীর প্রথম গোয়েন্দা কাহিনি

জানা অজানা পাচমিশালী

পৃথিবীর প্রথম গোয়েন্দা কাহিনি

 – হেমেন্দ্রকুমার রায়

তোমরা সবাই নিশ্চয়ই ডিটেকটিভ গল্প বা গোয়েন্দা কাহিনি শুনতে ভালোবাসো। কেবল তোমরা কেন, পৃথিবীর সব দেশেই এ-শ্রেণির গল্পের আদর আছে। অনেক লেখক কেবল ডিটেকটিভ কাহিনি লিখেই অমর হয়েছেন। বাংলাদেশের পুরোনো গল্পে ও রূপকথাতেও গোয়েন্দা-কাহিনির অল্পবিস্তর দেখা মেলে।
আধুনিক ভালো গোয়েন্দার গল্প বলতে কতকগুলো চমকদার ঘটনার সমষ্টি বোঝায় না; কারণ, প্রধানত তার উদ্দেশ্য হচ্ছে, মানুষের সূক্ষ্মদৃষ্টি ও বুদ্ধির খেলা দেখানো। পাশ্চাত্য দেশে আধুনিক গোয়েন্দাকাহিনির স্রষ্টা বলে আমেরিকান লেখক এডগার অ্যালেন পোর নাম করা হয়। তিনি মাত্র গুটি তিনেক ছোট-ছোট গোয়েন্দার গল্প লিখে গেছেন, কিন্তু প্রত্যেকটি গল্পই অপূর্ব! সেগুলি কাল্পনিক গল্প হলেও সত্যিকার গোয়েন্দারাও যে তা পড়ে শিক্ষা লাভ করতে পারে, এমন প্রমাণও পাওয়া গিয়েছে।

 

একবার আমেরিকান একটি মেয়ে খুন হয়। তাই নিয়ে চারিদিকে মহা সাড়া পড়ে গেল। কিন্তু অনেক চেষ্টার পরেও পুলিশ খুনিকে ধরতে পারলে না। তখন পো সাহেব সেই খুন অবলম্বন করে একটি ছোটগল্প লিখছেন। প্রথমটা সকলেই গল্প হিসাবেই তাকে গ্রহণ করলে। কিন্তু কিছুদিন পরে সত্যিকার খুনের সঙ্গে জড়িত একাধিক ব্যক্তি যেসব কথা প্রকাশ করে দিলে তাতে জানা গেল যে, পো-সাহেবের সৃষ্ট কাল্পনিক ডিটেকটিভের সন্দেহ ও অনুমানই সত্য!
ইংরেজ লেখক স্যার আর্থার কন্যান ডইলের নাম আজ কে না জানে? তার লেখা শার্লক হোমসের গল্প পৃথিবীর সব দেশেই ছড়িয়ে পড়েছে। কিন্তু এডগার অ্যালেন পো যদি গোয়েন্দার গল্প না লিখতেন, তাহলে শার্লক হোমসের নাম আজ কেউ শুনতে পেত কিনা সন্দেহ!
তবে, আসলে আধুনিক গোয়েন্দা কাহিনির উৎপত্তি হয়েছে আঠারো শতাব্দীতে ফরাসি দেশে। তোমরা এখনও ভলতারের বই পড়োনি বোধহয়? রুশো নামে আর এক ফরাসি লেখকের সঙ্গে ভলতারের রচনা ফরাসি বিপ্লবের মূলে কাজ করেছিল যথেষ্ট। এই ভলতারের একখানি উপন্যাস আছে, তার নাম–জ্যাড উইগ। সেই উপন্যাসে দেখা যায়, রানির কুকুর ও রাজার ঘোড়া হারিয়ে গেল, কিন্তু জ্যাডউইগ পথের উপরে কেবল তাদের পদচিহ্ন দেখে বলে দিলে, কুকুরটা মদ্দা না মাদি, সেটা কোন জাতের, তার বাচ্চা হয়েছে কিনা। ও তার ল্যাজ কত বড় এবং ঘোড়ার আকার কত উঁচু, তার পা খোঁড়া কিনা প্রভৃতি আরও অনেক আশ্চর্য কথা।
এই জ্যাডউইগের বুদ্ধি-কৌশলে রাজা কেমন করে সাধু কোষাধ্যক্ষ পেয়েছিলেন, সে গল্পটাও শোনবার মতো।
একদিন রাজা দুঃখ করে বললেন, জাড়উইগ, আজ পর্যন্ত আমি কোনও সাধু কোষাধ্যক্ষ পেলুম না। যাকে কোষাধ্যক্ষের পদ দিই, সে-ই দুহাতে টাকা চুরি করে। তুমি তো এত বুদ্ধিমান, সাধু কোষাধ্যক্ষ পাওয়া যায় কেমন করে, বলতে পারো?
জ্যাডউইগ বললে, পারি মহারাজ! যে সবচেয়ে ভালো নাচতে পারবে, সে-ই সাধু কোষাধ্যক্ষ।
রাজা বললেন, পাগলের মতো কী যে বলো, ঠিক নেই! ভালো নাচিয়ে হলেই সাধু হবে? যা নয় তাই!
জ্যাডউইগ বললে, আমার কথা সত্য কিনা পরীক্ষা করে দেখুন না! আমি যা-যা বলি তার ব্যবস্থা করে দিন।
কী ব্যবস্থা?
রাজসভার পাশের একখানা ঘরে রাশি রাশি হিরে-চুনি-পান্না রেখে দিন। তারপর যারা আপনার কোষাধ্যক্ষ হওয়ার জন্যে দরখাস্ত করেছে, তাদের একে একে সেই ঘরে ঢুকে সভায় আসতে বলুন। ঘরের বাইরে সেপাই পাহারা দিক, কিন্তু ভিতরে যেন কেউ না থাকে।
রাজা তখনি জ্যাডউইগের কথামতো সব ব্যবস্থা করে দিলেন।
নির্দিষ্ট দিনে যারা কোষাধ্যক্ষের পদ চায় তারা প্রত্যেকেই সেই রত্নগৃহের ভিতর দিয়ে একে একে রাজসভায় এসে দাঁড়াল।
রাজা বললেন, তোমরা কোষাধ্যক্ষ হতে চাও? বেশ, তা হলে নাচ আরম্ভ করো। সে কী মহারাজ! নাচতে হবে?
হ্যাঁ, হ্যাঁ, যে নাচবে না তার আবেদনও গ্রাহ্য হবে না। ধরো নাচ!
রাজার সিংহাসনের পিছনে দাঁড়িয়ে জ্যাডউইগ দেখলে, কোষাধ্যক্ষ পদপ্রার্থীরা হতাশ মুখে। নৃত্য শুরু করলে। কিন্তু তারা ভালো করে নাচতেই পারলে না–তাদের দেহ জড়োসড়ো ও আড়ষ্ট, মাথা হেঁট, দুই হাত শরীরের দুই দিকে সংলগ্ন, কারুর নাচেই স্বাধীন গতি নেই। ধুপ ধুপ করে মাটিতে পা ছুঁড়ে ধেই-ধেই করে নেচে তারা কেবল নাচের নামরক্ষা করছে মাত্র।
জ্যাডউইগ ক্রুদ্ধ স্বরে বললে, পাজি, ছুঁচো, বদমাইশের দল।
কিন্তু একটি লোক চমৎকার নাচছে! তার দেহে সঙ্কোচের কোনও লক্ষণই নেই, মাথা উন্নত, হাত-পায়ের লীলা মনোরম।
জ্যাডউইগ বললে, মহারাজ, এই লোকটি সাধু। একেই আপনার কোষাধ্যক্ষের পদ দিন!
রাজা বিস্মিত স্বরে বললেন, কী করে তুমি জানলে যে, এই লোকটি সাধু?
জ্যাডউইগ বললে, মহারাজ, এই একশোজন লোক আপনার কোষাধ্যক্ষ হতে এসেছে। কিন্তু ওই একজন ছাড়া বাকি সবাই যখন একে একে রত্নগৃহের ভিতর দিয়ে এসেছে, তখন লোভ সামলাতে না পেরে মুঠো মুঠো হিরে-চুনি-পান্না তুলে নিয়ে নিজের পকেটে পুরে ফেলেছে। কাজেই পাছে সেগুলো পকেট থেকে ঠিকরে বেরিয়ে পড়ে, সেই ভয়ে ওরা ভালো করে নাচতেই পারছে না।
রাজা দুঃখিতভাবে বললেন, একশো জনের মধ্যে মোটে একজন সাধু!
জ্যাডউইগ বললে, মহারাজ, একজন সাধু একাই একশো।
বলা বাহুল্য, সেই সাধু ব্যক্তিই কোষাধ্যক্ষের কাজ পেলে। বাকি লোকগুলোর কাছ থেকে চোরাই মাল কেড়ে নেওয়া হল তো বটেই, তার উপরে তাদের কঠিন শাস্তি দেওয়া হল।
কিন্তু আঠারো শতাব্দীর ইউরোপের কথা তো অতি-আধুনিক কথা। ডিটেকটিভ গল্পের সৃষ্টি হয়েছে আরও বহু শতাব্দী আগে। পৃথিবীতে যখন ঐতিহাসিক যুগ সবে আরম্ভ হয়েছে, তখনকারও একটি ডিটেকটিভ গল্প আমরা পেয়েছি। আমার দৃঢ় বিশ্বাস তার আগে পৃথিবীতে আর কোনও গোয়েন্দা কাহিনি লেখা হয়নি।
এই গল্পের নায়ক বা ডিটেকটিভ হচ্ছেন দানিয়েল, বাইবেলে যিনি জ্ঞানী ব্যক্তি বলে বিখ্যাত। ঘটনাক্ষেত্র হচ্ছে বাবিলন।
প্রাচীন বাবিলনে এক মস্ত দেবতা ছিলেন তাঁর নাম বেল। তাঁকে মহা-পর্বত বলেও ডাকা হত।
হিন্দুদের দেব-দেবীরা এক হিসাবে রীতিমতো নির্লোভ। তাদের সামনে যত ভালো খাবারই ভোগ বলে ধরে দাও, তারা নির্নিমেষ নেত্রে কেবল সেইদিকে তাকিয়ে থেকেই খুশি হন, পরে খাবারগুলো অদৃশ্য হয় প্রকাশ্য ভাবেই ভক্তদের ক্ষুধার্ত উদর-গহ্বরে। কে জানে মা কালীর যদি মাংস খাবার শক্তি থাকত, তাহলে কালীঘাটে এতবেশি পাঁঠা বলি হত কিনা!
কিন্তু বাবিলনের বেল ছিলেন দস্তুরমতো পেটুক দেবতা। তাঁর সামনে ভোগ দিলে ভক্তদের একটি কণাও প্রসাদ পাওয়ার উপায় ছিল না। অন্তত বাবিলনবাসীরা সেই কথাই মনে করত।
প্রকাণ্ড দেবালয়, তার চুড়ো যেন আকাশ ভেদ করতে চায়। দেবালয়ের সঙ্গেই সংলগ্ন এক প্রাসাদে ঠাকুরের পুরোহিতরা বউ-ছেলে-মেয়ে নিয়ে বাস করে।
ভোগমন্দিরে রাজবাড়ি থেকে রোজ বড় বড় থালায় রাশি রাশি উপাদেয় খাবার আসে, ঠাকুরের পেট ভরার জন্যে।
বেল-ঠাকুর খাইয়ে ছিলেন বটে, কিন্তু লোকের চোখের সামনে খেতে হয়তো তাঁর লজ্জা হয়। তাই তাঁর সামনে খাবারের থালাগুলো সাজিয়ে রেখে সবাই সরে পড়ে এবং রাত্রে মন্দিরের দরজা বাহির থেকে বন্ধ করে দেওয়া হয়।
কিন্তু রোজ সকালে উঠে দেখা যায় কী আশ্চর্য! পাথরের ঠাকুর বেল জ্যান্ত হয়ে সব খাবার খেয়ে হজম করে ফেলেছেন!
দেবতার শক্তি দেখে রাজার মনে ভক্তি-শ্রদ্ধা আর ধরে না এবং যাদের মন্ত্রশক্তিতে দেবতা এমন জাগ্রত, সেই পুরোহিত-সম্প্রদায়ের প্রভাব-প্রতিপত্তি ও লাভের অঙ্ক বেড়ে উঠল রীতিমতো।
এমন সময়ে ঘটনাক্ষেত্রে দানিয়েলের প্রবেশ। জাতে তিনি ছিলেন ইহুদি, বাবিলনে এসেছেন যুদ্ধে বন্দি হয়ে। কাজেই বেলের উপরে তার একটুও ভক্তি শ্রদ্ধা নেই।
দানিয়েল সমস্ত দেখেশুনে একদিন বললেন, মহারাজ, পাথুরে দেবতার পেটের ভিতরটাও নিরেট পাথরে ভরতি হয়ে আছে, রাশি রাশি মিষ্টান্ন, ফল আর মাংসের লোভে সে পেট ফঁপা হতে পারে না। বেল এসব খাবার খান না।
রাজা বললেন, কি যে বলো তার মানে হয় না। আমি স্বচক্ষে দেখেছি, রাত্রে মন্দিরের দরজা বাহির থেকে বন্ধ থাকে। মন্দিরের ভিতরে জনপ্রাণী থাকে না, তবু খাবার কোথায় উড়ে যায়?
দানিয়েল বললেন, আমার মুখে সে কথা শুনলে আপনি বিশ্বাস করবেন না। আমার কর্তব্য আমাকে করতে দিন, তারপর কাল সকালেই আপনাকে দেখাব, বেল খাবার খান না।
সে-রাত্রেও ষোড়শোপচারে ঠাকুরকে ভোগ দেওয়া হল।
তারপর দানিয়েল এসে প্রথমে মন্দিরের মেঝের উপর সর্বত্র ভালো করে ছাই ছড়িয়ে দিলেন এবং তারপর মন্দিরের দরজা বাহির থেকে বন্ধ করে দিয়ে চলে গেলেন।
সকাল হল। রাজাকে সঙ্গে করে দানিয়েল মন্দিরের সামনে এসে দাঁড়ালেন। দরজা খোলা হল। কিন্তু ভিতরে ঢুকে দেখা গেল, ঠাকুর চেটেপুটে সব থালার খাবার খেয়ে ফেলেছেন।
রাজার পুরোহিতরা ও সাঙ্গোপাঙ্গোরা দানিয়েলকে লক্ষ করে বললে, কোথাকার এক অবিশ্বাসী ইহুদি এসে আমাদের এত বড় ঠাকুরের শক্তিতে সন্দেহ করে! কী স্পর্ধা!
রাজা দেবমূর্তির দিকে তাকিয়ে ভক্তিভরে গদগদ স্বরে বললেন, হে বাবিলনের সনাতন দেবতা, হে মহাপ্রভু বেল! অসীম তোমার মহিমা, জাগ্রত তোমার উদর!
দানিয়েল কিন্তু কিছুমাত্র দমলেন না। হাসিমুখে বললেন, মহারাজ, মন্দিরের মেঝের দিকে তাকিয়ে দেখুন!
ছাই-ছড়ানো মেঝের দিকে তাকিয়ে রাজা সবিস্ময়ে বললেন, একী! এখানে এত ছাই কেন? ছাইয়ের উপরে এত পায়ের দাগ এল কেমন করে? এ যে দেখছি পুরুষের পায়ের দাগ, মেয়ের পায়ের দাগ, শিশুর পায়ের দাগ। এসবের মানে কী?
দানিয়েল বললেন, মানে খুব স্পষ্ট, মহারাজ! মন্দিরের পিছনে এক গুপ্তদ্বার আছে। পুরুতরা তাদের বউ আর ছেলেমেয়েদের নিয়ে সেই দরজা দিয়ে ভিতরে ঢুকে দেবতার ভোগ পেট ভরে খেয়ে পালায়। কিন্তু কাল যে আমি এখানে ছাই ছড়িয়ে রেখেছি, অন্ধকারে সেটা তারা দেখতে পায়নি। তাই পায়ের দাগই তাদের ধরিয়ে দিলে।
তখন রাজার চোখ ফুটল। বেলের উপরে তাঁর ভক্তি কমল কিনা জানি না, কিন্তু পুরোহিতদের প্রাণদণ্ড হল!

 

লেখক পরিচিতি :                                                                                                                                                  

প্রখ্যাত সাহিত্যিক ও গীতিকার হেমেন্দ্রকুমার রায় ছোটদের জন্য রহস্য রোমাঞ্চ ও গোয়েন্দা গল্প লেখার জন্য বিখ্যাত ছিলেন। তার প্রকৃত নাম প্রসাদদাস রায়। ১৮ এপ্রিল ১৮৮৮ সালে কলকাতায় জন্মগ্রহন করেন। তার কয়েকটি গল্প ও উপন্যাস চলচ্চিত্রায়িত হয়েছে। ১৮ এপ্রিল ১৯৬৩ সালে তিনি পরলোক গমন করেন।

Sharing is caring!

Besogo Editor

বাংলাভাষী পাঠকের ব্যস্ত দৈনন্দিন জীবনকে আরো বেশি উপভোগ্য, ছন্দময় ও জ্ঞাত করার প্রয়াসে বিসর্গ নামক এই বাংলা পোর্টালের সৃষ্টি। কৃতজ্ঞতার সাথে বিসর্গ টিম সকল লেখক ও কন্ট্রিবিউটরের অবদান স্মরণ করে। বিশেষ করে উপরের সংগৃহিত পোস্টটির জন্য লেখক সহ সকলের কাছে বিসর্গ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছে।

1 thought on “পৃথিবীর প্রথম গোয়েন্দা কাহিনি

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *