তিন মুসাফির

শিক্ষনীয় মজার গল্প: তিন মুসাফির

ছোট গল্প

তিন মুসাফির

             – জসীমউদ্দীন

আগেকার দিনে একদল লোক দেশে দেশে মুসাফিরী করে বেড়াত। নানা জায়গায় ঘুরে তারা সকল দেশের নিয়ম ও রীতিনীতি জেনে বইপুস্তক লিখত। তাদের মধ্যে হিন্দু, মুসলমান, খ্রিস্টান, ইহুদি, সবাই থাকত। ভিন্ন জাতের বলে কেউ কাউকে অবহেলা করত না।
এমনি তিন মুসাফির বিদেশ ভ্রমণে বের হয়েছে। একজন ইহুদি, একজন খ্রিস্টান, আর একজন মুসলমান। সেদিন তারা ঘুরতে ঘুরতে এক নতুন দেশে এসে উপস্থিত হল। পথ চলে তারা যেমনই হয়রান, তেমনই ক্ষুধায় কাতর ছিল। কিন্তু তখন অনেক রাত হয়ে গেছে। গৃহস্থেরা সবাই ঘরদোর বন্ধ করে ঘুমিয়ে পড়েছে। না পেল তারা খাবার না পেল থাকার জায়গা! একটা বটগাছের তলায় কম্বল বিছিয়ে তারা শোয়ার জোগাড় করল।
এমন সময় একটি লোক সামান্য কিছু মিঠাই এনে তাদের উপহার দিল। তিনজনেরই এত ক্ষুধা পেয়েছিল যে, এই সামান্য মিঠাই ভাগ করে খেলে তাদের কারোই পেট ভরবে না। ক্ষুধার সময় সামান্য কিছু খেলে ক্ষুধা আরও বাড়ে। তাই তাদের মধ্যে ইহুদি মুসাফিরটি ছিল অতি চালাক। সে বলল, “এসো ভাই! আমরা সকলেই ঘুমিয়ে পড়ি। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে যে সবচাইতে ভাল স্বপ্ন দেখবে, সে-ই মিঠাই খাবে।” সে ভেবেছিল বানোয়াট গল্প বলে সকালবেলা সেই মিঠাই সে খাবে।
একথা সকলেই মেনে নিল। তারা যার যার বিছানায় শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ল।
শেষরাত্রে মুসলমান মুসাফির জেগে উঠল।– জেগে উঠে টপাটপ করে সমস্ত মিঠাই খেয়ে ফেলল, আর মিঠাই এর পাত্রটি রুমাল দিয়ে ঢেকে রাখল।
ইহার মধ্যে ভোর হয়েছে। খ্রিস্টান আর ইহুদিও আড়ামোড়া দিয়ে জেগে উঠল। তখন তারা একে অপরকে জিজ্ঞাসা করতে লাগল, কে কেমন স্বপ্ন দেখেছে। প্রথমে খ্রিস্টান বলতে আরম্ভ করল, “আরে, ভাই, আমি যে কি মজার স্বপ্ন দেখেছি!”
ইহুদি এগিয়ে এসে বলল, “কি দেখেছ, ভাই?”
খ্রিস্টান বলতে লাগল, “দেখলাম, আমি যেন আকাশে উড়তে উড়তে সেই ৪র্থ্ আসমানের উপর গিয়ে দাঁড়ালাম। সেখানে ঈসা নবী (আলাইহিস সালাম) আমার হাতটি ধরে কত কথাই না বললেন!”
ইহুদি বলল, “আমি ভাই আরও ভাল স্বপ্ন দেখেছি! কোথাকার একটা ময়ূর এসে আমাকে তার পাখায় বসিয়ে উড়িয়ে নিয়ে গেল। তারপর নানা দেশ ঘুরিয়ে আমাকে সেই কোহে তুর পাহাড়ে এনে পৌছে দিল। সেখানে দাঁড়িয়ে আমি আল্লার সঙ্গে কথা বললাম।”
সে মনে মনে ভাবছিল এর চেয়ে আর ভালো কোন স্বপ্ন হতে পারে না। তাই মেঠাই তার ভাগেই রয়েছে।
এরপর তারা মুসলমান মুসাফিরকে জিজ্ঞাসা করল, “এবার তোমার স্বপ্ন বল ভাই।”
মিঠাই খাওয়ার একটা লম্বা ঢেকুর তুলে এবার মুসলমান মুসাফির আরম্ভ করল, “আমার স্বপ্নটা ভাই বড়ই খারাপ।”
ইহুদি আর খ্রিস্টান খুশি হয়ে জিজ্ঞাসা করল, “বলেই ফেল না ভাই, কেমন স্বপ্ন দেখলে!”
মুসলমান কহিল, “আমি ভাই, দেখলাম, কোথাকার এক ভীষণ দৈত্য এসে আমার ঘাড় ধরে বলল, “জলদি মিঠাই খেয়ে ফেল— নতুবা তোকে গলা টিপে মারব। আমি আর কি। করব, তাড়াতাড়ি সবটা মিঠাই খেয়ে ফেললাম।”
এই বলে রুমালের ঢাকনি সরিয়ে মিঠাই-এর খালি পাত্রটা দেখিয়ে দিল। ইহুদি আর খ্রিস্টান তখন একবাক্যে জিজ্ঞাসা করল, “তুমি ভাই, আমাদের ডাকলে না কেন? আমরা উঠে দৈত্যটাকে তাড়িয়ে দিতাম।”
মুসলমান বলল, “ডাক কি কম দিলাম নাকি ভাই! কত জোরে জোরে তোমাদের ডাকলাম।”
তারা দুইজন জিজ্ঞাসা করল, “কিন্তু আমরা দুইজন তো নিকটেই ছিলাম; তবে শুনলাম না কেন?”
মুসলমান বলল, “কি করে শুনবে ভাই! তোমাদের একজন ছিলে সেই ৪র্থ্ আসমানের উপরে, আর একজন ছিলে সেই অত দূরে কোহেতুর পাহাড়ের উপরে। আমার ডাক অত দূর পর্যন্ত যাবে কি করে?”

 

 

লেখক পরিচিতি:
পল্লীকবি জসীমউদ্দীন ১৯০৩ সালের ১ জানুয়ারি ফরিদপুর জেলার তাম্বুলখানা গ্রামে মাতুলালয়ে তাঁর জন্ম। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে তিনি এম.এ (১৯৩১) পাস করেন।
কর্মজীবন শুরু করেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালযয়ের পল্লিসাহিত্যের সংগ্রাহক হিসেবে। পরে ১৯৩৮ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে লেকচারার পদে যোগদান করেন। তারপর ১৯৪৪ সালে প্রথমে তিনি বঙ্গীয় প্রাদেশিক সরকার এবং পরে পূর্ব পাকিস্তান সরকারের প্রচার বিভাগের কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
তিনি তাঁর কবিতায় পল্লিপ্রকৃতি ও পল্লিজীবনের সহজ-সুন্দর রূপটি তুলে ধরেন। কলেজজীবনে ‘কবর’ কবিতা রচনা করে তিনি বিপুল খ্যাতি অর্জন করেন। তাঁর প্রধান গ্রন্থগুলি হলো: নক্সী কাঁথার মাঠ, সোজন বাদিয়ার ঘাট, রঙিলা নায়ের মাঝি, পদ্মাপার, বেদের মেয়ে, পল্লীবধূ, ডালিম কুমার ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
জসীমউদ্দীন বাংলা সাহিত্যের একজন বিশেষ সম্মানিত ও বহু পুরস্কারে পুরস্কৃত কবি। ১৯৭৬ সালের ১৩ মার্চ তিনি ঢাকায় মারা যান।
সূত্র: বাংলাপিডিয়া

Sharing is caring!

Shajahan Manik

ইংরেজি প্রভাষক শাহ্জাহান মানিক একাধারে কবি, লেখক, গবেষক ও অনুবাদক। একাধিক কাব্যগ্রন্থ ছাড়াও তার অনুদিত বইয়ের সংখ্যা ১০টি। এছাড়া সায়েন্স ফিকশন, সম্পাদনা, ছোটদের বইয়ের পাশাপাশি তার রয়েছে ইংরেজি শেখার বই। তার সর্বশেষ প্রকাশিত গ্রন্থ হচ্ছে- মানব কল্যাণে মুসলিম বিজ্ঞানীদের অবদান।

https://besorgo.com

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *