ভাবুন তো একবার চাঁদে আপনার নিজস্ব জমি থাকবে ! তাও এক বা দু’কাঠা জমি নয়, চাইলে একরের পর একর হিসাবে জমি কিনে দলিল বগলদাবা করে ঘুরে বেড়াতে পারেন। আর ঘুরছেন অনেকেই। মার্কিন সাবেক প্রেসিডেন্ট থেকে শুরু করে ভারতের জনপ্রিয় নায়ক শাহরুক খানও আছেন সে তালিকায়! এছাড়া কয়েকদিন আগে বাংলাদেশের একজনও চাঁদে জমি কিনে প্রচারের শিরোনাম হয়েছিলেন। তাহলে চুলন চাঁদে জমি কেনার বিষয়টা জেনে নেয়া যাক-
চাঁদে জমি কেনা ও বিক্রির বিষয়টি শুরু হল যেভাবে
৮০ দশকের ঘটনা। স্নায়ূযুদ্ধের কারণে সারা পৃথিবীব্যাপী অস্থিরতা তখন তুঙ্গে। সবার মধ্যে এক আতংক না জানি কখন পারমাণবিক যুদ্ধ লেগে যায়। বহু মানুষ তাই পারমাণবিক যুদ্ধ থেকে বাঁচার উপায় খুঁজছিলো। আর সেই ইস্যুকে কাজে লাগিয়ে তখন ডেনিস হোপ নামক এক ব্যাক্তি পারমাণবিক যুদ্ধ থেকে বাঁচতে চাঁদে বসতি করার কথা প্রথম সামনে আনেন। এর আগে ডেনিস হোপ ছিলেন একজন জুতা বিক্রেতা। যিনি ১৯৮০ সালের কিছু আগে ডিভোর্স এর পরে দেউলিয়া হওয়ার পথে ছিলেন। এদিকে তার জুতার ব্যবসাও প্রায় শেষের পথে ছিল। এমন সময় একদিন সন্ধ্যায় তিনি ল্যান্ড-প্রোপার্টি বিক্রির ব্যবসার কথা ভাবতে শুরু করেন। কিন্তু এ খাতে ইনভেস্ট করার মত পর্যাপ্ত মূলধন তার ছিলনা। ভাবতে ভাবতে এক সন্ধ্যায় তিনি জানলার দিয়ে বাইরে তাকাতেই চাঁদ দেখতে পান। আর তখনই তার মাথায় আসে চাঁদে জমি বিক্রির বিষয়টা। সাথে সাথে হোপ কাজে লেগে যান।
এমনিতে তার রাষ্ট্রবিজ্ঞানের উপর পড়াশুনা ছিল। সেই সাথে স্থানীয় পাঠাগার ও অন্যান্য ক্ষেত্র থেকে মহাকাশ বিষয়ে গবেষণা শুরু করেন। এরপর জানতে পারেন ১৯৬৭ সালের মহাকাশ চুক্তি সম্পর্কে। ১৯৬৭ সালে আনা ঐ প্রস্তাবে পৃথিবীর প্রায় সবক’টি দেশ সম্মতি দিয়েছিল। ঐ প্রস্তাবের মূল বিষয় ছিল সৌরজগতের মধ্যে থাকা মহাজাগতিক বস্তু। চুক্তিতে স্পষ্ট লেখা ছিল যে, বিশ্বের কোনো দেশ বা কোনো দেশের সরকার সৌরজগতের কোনো মহাজাগতিক বস্তুর উপর নিজেদের অধিকার, মালিকানা বা আইনি সত্ত্ব দাবি করতে পারবে না। অনেক ঘেটে জাতিসংঘের ঐ চুক্তির একটি প্রস্তাবে এক ফাঁক খুঁজে পান হোপ। তা হল এই চুক্তিতে স্পষ্টভাবে দেশের কথা লেখা হয়েছে কোনও ব্যক্তি নয়। তাহলে চাইলেই কোনো ব্যক্তি চাঁদ বা অন্য কোনও গ্রহকে নিজের দাবি করতেই পারে।
আমেরিকার আইন অনুযায়ী কোনও ব্যক্তি যদি মালিকবিহীন জমি কিংবা সম্পত্তি নিজের দাবি করে সরকারি কোনও কর্মকর্তা কর্তৃক স্বাক্ষর করাতে পারে এবং অন্য কোন মানুষ বা কেউ তার দাবি না রাখে তবে সেই ব্যক্তিই ওই সম্পত্তির মালিক হয়ে যায়। এ বিষয়ও তিনি কাজে লাগান।
যথেষ্ঠ কাঠখড় পুড়িয়ে একটি ডকুমেন্ট তৈরি করে স্থানীয় মেয়রের অফিস থেকে সেটি করান হোপ । তারপর স্বাক্ষর করা ঐ কপিসহ দুইটি চিঠি যথাক্রমে রাশিয়া এবং জাতিসংঘের এর কার্যালয়ে পাঠান তিনি। আশির দশকের একেবারে গোড়ার দিকে জাতিসংঘকে লেখা ওই চিঠিতে চাঁদের জমি এবং খনিজ সম্পদের মালিকানা দাবি করেন হোপ। কিন্তু সে চিঠির জবাব আজও আসেনি এবং রাশিয়া বা জাতিসঘে কেউই চাঁদকে নিজের দাবি করেনি। আর কোনো উত্তর না পেয়ে এবং জাতিসংঘের মৌনতাকে সম্মতি ধরে নিয়েই চাঁদকে নিজের সম্পত্তি বলে ঘোষণা করেন বসেন হোপ। পাশাপাশি আমেরিকার আইন অনুযায়ী ড্যানিস হোপই হয়ে যায় চাঁদ এর মালিক। শুধু চাঁদকে নিজের সম্পদ বলে বসে থাকেন নি তিনি, এমনকি চাঁদে জমি বিক্রির জন্য পত্রিকা ও ওয়েবসাইট পর্যন্ত খুলে বসেন। চাঁদের জমি বিক্রির বিজ্ঞাপনও নিয়মিত দিয়ে চলেছেন।
কারা বিক্রি করছে চাঁদে জমি
চাঁদে জমি বিক্রি করছে মূলত মার্কিন নাগরিক ডেনিস হোপের সংস্থা ‘লুনার অ্যাম্বাসি’। যার বাংলা অর্থ চন্দ্র দূতাবাস। লুনার অ্যাম্বাসির সিইও হচ্ছেন হোপ নিজেই। যদিও এই সিইও’র অর্থ সেলেশ্চিয়াল এগজিকিউটিভ অফিসার। যার বাংলা অর্থ মহাজাগতিক বিশেষ অধিকর্তা। তবে নিজেকে ‘চাঁদের মালিক’ বলতেই বেশি পছন্দ করেন হোপ। তার সংস্থাটি কেবল জায়গাজমির ‘দেখভাল’ করে।
চাঁদের জমির দাম ও কেনার প্রক্রিয়া
পৃথিবীর জমির চেয়ে হোপের চাঁদের জমির দাম অনেকটাই কম, তাই এই জমি কেনা সাধারণ জনগণের সাধ্যের মধ্যেই রয়েছে। হোপের তথ্য মতে, একরপ্রতি ২৪.৯৯ মার্কিন ডলার বা থেকে শুরু হয়ে তার জমি (যা বাংলাদেশি প্রায় ২ হাজার টাকার সমান) বিক্রি হচ্ছে ৫০০ ডলার পর্যন্ত। তবে বেশি দামের জমিও আছে। এক একটি মহাদেশের সমান সেই জমির দাম প্রায় ১৪ কোটি ডলারের কাছাকাছি। তার ভাষ্য, চাঁদের সবচেয়ে বৃহদাকৃতি জমির অংশটিতে ৫৩ লাখ ৩২ হাজার ৭৪০ একর জায়গা আছে। যদিও সেই জমির ক্রেতা এখনও পাননি। বেশি চাহিদা ১৮০০-২০০০ একরের জমিগুলোর।
হোপের জমি কিনতে হলে সরাসরি তার অফিসে যেতে হবে। অথবা তাদের ওয়েবসাইটেও যোগাযোগ করতে হবে।
তবে চাঁদে জমি কিনলেও তা চোখে দেখার সুযোগ প্রায় নেই। তাই দলিলের সঙ্গে ক্রেতাদের একটি করে চাঁদের মানচিত্র দেন হোপ। জানা গেছে, জমি কেনার পর ক্রেতাকে একটি বিক্রয় চুক্তি, কেনা জমির একটি স্যাটেলাইট ছবি এবং জমিটির ভৌগলিক অবস্থান ও মৌজা-পর্চার মতো আইনি নথিও প্রদান করে সংস্থাটি। এছাড়া, কেউ চাইলে তাদের জন্য চাঁদের সম্পূর্ণ মানচিত্র এবং অন্যান্য তথ্যও সরবরাহ করা হয়। অবশ্য এর জন্যে অতিরিক্ত অর্থ গুণতে হয়। যা দিয়ে কেউ বুঝতে পারবেন ঠিক কোন জায়গায় জমি কিনলেন। তবে জমি যেমনই হোক, একটি বিষয় নিশ্চিত করেছেন হোপ, বিক্রিত জমির সব জায়গা থেকেই পৃথিবীকে সমান ভাবে দেখা যাবে।
যারা চাঁদের জমির ক্রেতা
ক্রেতার ব্যাপারে কোনো বাছবিচার নেই হোপের। তারকা থেকে সাধারণ চাকুরিজীবী সবাই রয়েছেন তার ক্রেতার তালিকায়। এ পর্যন্ত বিশ্বজুড়ে ৬০ লাখেরও বেশি ক্রেতাকে চাঁদের ৬১.১ কোটি একর জমি বিক্রি করেছেন হোপ। এর মধ্যে ৬৭৫ জন নামী তারকাও জমি কিনেছেন বলে জানিয়েছেন তিনি। ক্রেতাদের মধ্যে নাকি তিন সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ, জিমি কার্টার ও রোনাল্ড রিগ্যানও রয়েছেন। আছে ম্যারিয়ট হিলটনের মতো বেশ কিছু হোটেল কর্তৃপক্ষও। ইতোমধ্যে বলিউড তারকাদের মধ্যে শাহরুখ খান একখণ্ড জমির মালিক হয়েছেন চাঁদে। সেখানে জমি কিনেছিলেন প্রয়াত অভিনেতা সুশান্ত সিং রাজপুত।
তার দাবি, চাঁদের জমির চাহিদা ভালই। এমন নাকি অনেকেই আছেন যারা জমি কিনতে বার বার ফিরে আসেন তার সংস্থায়।
চাঁদের জমির কেনার ও জমির বৈধতা
হোপ জানিয়েছেন, তার জমি বিক্রির বিষয়টি বৈধ। কারণ দলিল, মৌজাসহ সব আইনি নথিও রয়েছে তার। ১৯৮০ সাল থেকে শুরু হয়ে গত ৪১ বছর ধরে বেশ রমরমিয়ে চলেছে হোপের চাঁদের জমির ব্যবসা।
তবে আইন বিশেষজ্ঞদের মতানুসারে, এই জমি বিক্রির প্রক্রিয়া বৈধ হতে পারে না। তার কারণ প্রশাসন বা সরকার ছাড়া কেউ জমি বিক্রি করতে পারে না। এদিকে হোপও কম যান না! বিষয়টি জানার পরই অবশ্য দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহন করেন। নিজস্ব সরকারই তৈরি করে ফেলেন তিনি। নাম দেন গ্যালাকটিক ইনডিপেন্ডেন্ট গভর্নমেন্ট। হোপ সেই সরকারের প্রেসিডেন্ট। ২০০৯ সালে হোপের গ্যালাকটিক গভর্নমেন্ট আমেরিকার সরকারের মান্যতাও পায়। খোদ হিলারি ক্লিন্টন সই করেছিলেন গ্যালাটিক ইলডিপেন্ডেন্ট সরকারের স্বীকৃতি পত্রে।
সরকার থাকলে সংবিধান লাগে, দরকার নিজস্ব মূদ্রা, পতাকা, প্রতীক-সহ আরও অনেক কিছু। হোপ কার সবই বানিয়েছেন। এমনকি তার সরকারের নিজস্ব মূদ্রা রয়েছে। আছে নিজস্ব আইন-কানুনও। লুনার অ্যাম্বাসির নিজস্ব ওয়েবসাইট এর পাশাপাশি আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়া, নেভাদা ছাড়াও জাপান এবং কোরিয়ায় রয়েছে তার কার্যালয়। মূল কার্যালয় আমেরিকার নেভাদায় অবস্থিত।
চাঁদ ছড়িয়ে ভিনগ্রহে
এদিকে ৪১ বছরের ব্যবসায়ে এখন আর অবশ্য শুধু চাঁদে থেমে নেই হোপ। পৃথিবীর উপগ্রহ থেকে তাঁর ব্যবসা ছড়িয়েছে ভিন্গ্রহেও। একই আইনের ফাঁক গলে এখন বুধ, মঙ্গল, শুক্র, প্লুটো এমনকি বৃহস্পতির উপগ্রহ আইও-তেও জমি বিক্রি শুরু করছেন তাঁরা। হোপ জানিয়েছেন খুব শিগগিরি তাঁদের মহাজাগতিক জমির ব্যবসার পরিসর আরও বাড়বে।
এর শেষ কোথায় ?
লুনার অ্যাম্বাসির ওয়েবসাইট অনুযায়ী এখন পর্যন্ত তাদের কাছ থেকে সর্বোমোট ৬১১ মিলিয়ন একর জমি মানুষ কিনেছে। কিন্তু আসলেই কি তাই? তাহলে তো ড্যানিস হোপ এর পৃথিবীর সব চেয়ে বড় ধনীদের তালিকায় থাকার কথা।
আসলে পুরোটাই ড্যানিস হোপ এর সাজানো। সাংবাদিকরা তার কাছে চাঁদের দলিল দেখতে চাইলে তিনি নিজের বানানো একটি দলিল দেখায় সে। তার অঞ্চলের মেয়রের অফিসে জানতে চাওয়া হলে তারা এ সম্পর্কে কিছু জানেনা বলে দাবি করেছে। আসল দলিল তিনি সুরক্ষিত রেখেছেন বলে দাবি করেন। তবে হ্যাঁ তার কাছ থেকে অনেকেই মজা করে কিংবা গিফট হিসেবে চাঁদের জমি ক্রয় করেছেন। যা থেকে তার বাৎসরিক ২৭ থেকে ৩০ হাজার ডলার আয় হচ্ছে। ড্যানিস হোপ ১৯৯৫ সাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত নিজের বানানো এই স্ক্যাম থেকে আয় করছেন।
ক্রেতারা আগ্রহ দেখালেও অতীতে লুনার অ্যাম্বাসির কর্মকান্ডকে সে ভাবে গুরুত্ব দেননি কেউ। কিন্তু এখন হোপের দাবি অনেককেই ভাবাচ্ছে।
আপাতত হোপের সামনে চ্যালেঞ্জ একটাই। জাতিসংঘ। লুনার অ্যাম্বাসির মহাজাগতিক অধিকারের চিঠির জবাব যদি শেষ পর্যন্ত তারা দিয়ে দেয় এবং তাদের দাবি খারিজ করে দেয় তবে ৬০ লক্ষ বিশ্ববাসীর চাঁদ ধরার স্বপ্ন ভঙ্গ হবে।
সূত্র: ইউএসএ টুডে/ এসবি.