একুশের চেতনা এবং আমাদের সাংস্কৃতিক আত্মপরিচয়
– ড. সেলু বাসিত
ব্যক্তিস্বাতন্ত্র, গণতন্ত্র কিংবা জাতীয়তাবাদ সম্পৃক্ত ভাব আন্দোলনের সূত্রপাত ব্রিটিশ-ভারতে, উপনিবেশিক পরিবেশ বাস্তবতা, শিক্ষা ব্যবস্থাপনা আর রাষ্ট্রীয় আনুকুল্য নির্ভর পাশ্চাত্য চৈতন্য বিকাশের ধারায়। এ-পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা এতদাঞ্চলের জনমানসিকতার মনস্তাত্বিক পরিবর্তন এ বঙ্গে শিক্ষা-সাংস্কৃতিক-নৈতিকায় প্রভাব সৃষ্টির সাথে মধ্যবিত্ত ভিত্তিক শ্রেণি উত্থানকে বিবেচনায় আনলে জীবনীশক্তিহীন পাকিস্তানের জন্মলগ্নে ভাষার প্রশ্নে স্বাতন্ত্র্যচিন্তার উদ্বেলিত আন্দোলন অনেকাংশে বাঙ্গালিত্বের স্বপ্ন এবং অসাম্প্রদায়িকতার ভাবনার উন্মেষ ঘটে। সে ভিত্তিতেই ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে ভাষা আন্দোলনে মহান একুশের অন্তস্থিত তাৎপর্য যদি আমরা উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হই তাহলে আজকে আমাদের আত্মপরিচয় সংকট আর সাম্প্রদায়িক বাস্তবতাকে নিয়ে জাতিগত দ্বিধা এবং প্রগতিশীল চেতনা ধারায় যে স্থবিরতা তা থেকে উত্তরণ ঘটবে না।
বহিরাগত ভাবধারায়, বহিরাগত ভাষা, বহিরাগত ঔপনিবেশিক উত্তরাধিকার স্বীয় চেতনা ও সাংস্কৃতিক সংমিশ্রণে আত্মপরিচয় প্রপঞ্চ নিয়ে অমর্ত্য সেনের ‘আইডেন্টিটি এন্ড ভায়োলেন্স: দি ইলিউশন অফ ডেসটিনি’ গ্রন্থে তিনি যথার্থ বলেছেন : ‘আত্মপরিচয় একটি গোলমেলে ধারণা। ভুল হাতে পড়লে এসব গোলমেলে ধারণা নানারকম দুষ্কর্মে ব্যবহৃত হয় … মানুষের নৃতাত্ত্বিক, ধর্মীয় কিংবা ওই জাতীয় কোনো একটি বিশেষ পরিচয় চিহ্ন প্রায়শই বিভ্রান্তিকর। যারা তা করতে চায় তাদের উদ্দেশ্য বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সন্দেহজনক।’ অমর্ত্য সেনের এই অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায় বাংলাদেশকে মডারেট মুসলিম কান্ট্রি হিসেবে পরিচয় করানোর হীন উদ্দেশ্য।
॥ দুই ॥
ত্রিশের দশক-ব্যাপ্ত স্পেনের গৃহযুদ্ধ কেন্দ্রিক International Column এর রালফ, ফক্স, কডওএল, লরকার মতো শিল্পী এবং বুদ্ধিদীপ্ত মানুষেরা আত্মনিয়োজিত ছিলেন পৃথিবী ব্যাপি প্রগতির স্বপক্ষে। শুধু তাই নয় অসুন্দর অকল্যাণের বিপক্ষে দায়বদ্ধতার প্রেরণা সৃষ্টি করেছিলেন তাঁরা। এরই প্রভাব উত্তাপে চল্লিশের গণ-চেতনা সমৃদ্ধ উত্তেজনা ধারণ করে পঞ্চাশের দশকে প্রথমবারের মতো সলিল চৌধুরীর রচনায় এবং প্রবীর মজুমদার ও অমল চট্টেপাধ্যায়ের স্বরলিপিতে প্রকাশ পায় ‘ঘুমভাঙার গান’ শীর্ষক গণসংগীত সংকলন। তখন বলা হয়েছিল “প্রগতিশীল সংগীতের উপর সাধারণ মানুষের ভালোবাসা চির-কালীন ও সর্বদেশীয়। আমাদের প্রগতিশীল সংগীতের ধারা কোন উৎস থেকে উৎসারিত হয়ে কোন দিকে প্রবাহিত হবে যা হওয়া উচিত এই নিয়ে নানারকম মতান্তর দেখা দিয়েছে”- ভারতবর্ষে এই মতান্তরকে যথাসম্ভব গীতি-সংকলন ও গণআন্দোলনে প্রগতিশীল পথে এনে জাগরণের গানের দ্বারা উদ্দীপনা আর চেতনা ধারায় জাতিগত এবং আত্মগত প্রণোদনা সৃষ্টির প্রচেষ্টা নেওয়া হয়।
১৯৪৩-এ গণসংগীত ও গণনাট্য আন্দোলনের সাংগঠনিক জন্ম হয়। ১৯৩৮-৪৮ এ-সময়কালে গণসংস্কৃতি আন্দোলন সুরমা উপত্যকা ও আসামে গড়ে উঠে। ১৯৪২-৪৩ খ্রিস্টাব্দে প্রগতি সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক গণআন্দোলন সেখান থেকেই হেমাঙ্গ বিশ্বাস’দের দ্বারাই সৃষ্টি হয় প্রগতি চেতনার সুর-স্পন্দন- হৃদয় থেকে চেতনায়।
‘ব্রতচারী সখা’ নামে এ-ধরনের গণ-সম্পৃক্ত জাগরণমূলক সঙ্গীত নিয়ে গুরুসদয় দত্ত ব্রতচারী আন্দোলনের সূচনা করেছিলেন। যার উদ্দেশ্য ছিল স্বাধীন ভূমিতে স্বাধীন নাগরিক হলেই পূর্ণ জাতীয়তাবোধ থাকবে এমন কথা নেই তার জন্য চাই ভূমি প্রেম। আপন সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধা, জীবন সচেতনতা।… ‘বাংলাদেশের তরুণ-তরুণীরা যাতে ভবিষ্যতে দেহে মনে চরিত্রে এবং কর্মনিষ্ঠায় সত্যিকার বঙালী হিসাবে জগৎ সভায় শ্রেষ্ঠ আসন লাভ করতে পারে’ সে প্রচেষ্টা রূপে গুরুসদয় দত্তের অনুসারী কামরুল হাসান মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী কালে ব্রতচারী গান ও নৃত্যের প্রচলনের প্রচেষ্টা নিয়ে ছিলেন।
যার ফলে ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী একটা সৃজনশীল সময় ছিল উদ্দীপনা সৃষ্টির জন্য; বাণী-প্রধান সঙ্গীতে হয়েছে আত্মগত মানুষের মাঝে সময়ের অস্তিত্ব উন্মোচনের প্রয়াস। চেতনার উন্মেষ ঘটেছে, বিকশিত হয়েছে প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক বাংলাদেশের, যেখানে রাজনীতি-রাজনেতারা সংস্কৃতিমনস্ক জন থেকে গণ অন্বিষ্ট। অন্যের অনুভবে নিজেকে সত্যের মুখোমুখি করলে পরিশ্রুদ্ধি ঘটে- এ প্রত্যয়বোধ ছিল গণচেতনার আন্দোলনে সংগ্রামে।
১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দের বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের পর চেতনার নির্মম পট পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের অর্জনের নেতিবাচক প্রবাহের মধ্যে সংস্কৃতিই এগিয়ে নিয়েছে বাংলাদেশকে। সেই পরম্পরা আজকে আর রক্ষা হচ্ছে না, দেখা দিয়েছে স্থবিরতা ও বৃত্তাবদ্ধতার, যে কারণে প্রয়োজন হয়েছে পিছনে ফিরে দেখার। এই প্রজন্ম ভবিষ্যত প্রজন্ম হাতের কাছে আলোকিত হওয়ার বাতি পায়, সহজে শেখার জন্য স্বনিষ্ঠ হতে পারে, হতে পারে ন্যায্যতা, অসাম্প্রদায়িক আর শান্তির সৈনিক। সে লক্ষ্যে একুশের তাৎপর্যকে সামনে আনতে হবে।
সত্যেন সেন বলেছিলেন: “মানুষের কাছে পেয়েছি যে বাণী তাই দিয়ে রচি গান, মানুষের লাগি ঢেলে দিয়ে যাব মানুষের পরাণ।”
আজ সংস্কৃতিকরণ প্রক্রিয়া রাজনীতি বিবর্জিত ভাবে ধর্মকে যেমন ভিত্তি করে সমাজ-অর্থনীতিকে প্রভাবিত করছে, তেমনি ধর্মকে পাথেয় করে সংস্কৃতিতে সঞ্চারিত করছে সুরুচি, মুক্তবুদ্ধি ও নৈতিকতা বিবর্জিত ধর্মান্ধতা। এতে প্রভাব বিস্তারী জনচেতনা বিভ্রান্ত হয় এবং পারলৌকিক স্বখাত সলিলে নিমজ্জিত হয়ে ভুলে যায় মানবজাতির অপরাজেয় ধর্মতত্ত্বের অবস্থান হলো ‘চিরায়ত সাম্যবাদের হৃৎপিন্ডে।
বস্তুতঃ প্রকাশেই মনুষ্যত্ব প্রকাশেই ব্যক্তিত্ব, অপ্রকাশে সমস্ত একাকার। মহাজনরা বলেছেন : ‘মানুষ যতক্ষণ আপনাকে প্রকাশ না করিতেছে ততোক্ষণ তাহারা জনতা, যখনি আত্মপ্রকাশ করিল সে ব্যক্তি হইয়া উঠিল’ সেই নিষ্ঠাচার সৃষ্টি এখন জরুরী। ‘প্রকাশটা একটা একটা ঐশ্বর্য্যরে কথা-যেখানে মানুষ দীন সেখানে তো প্রকাশ নাই, অশেষের আবির্ভাব এবং এই অশেষই নানারূপে প্রকাশমান প্রকাশের অভাব যেখানে’ সেখানেই আমাদের উদ্যোগী হওয়া আবশ্যক।
‘অশ্রান্ত আর ফলিত ক্রোধ নিয়ে’ বিশ্বজুড়ে মহাজীবন যেভাবে লড়ছে এবং গড়ছে, মৃত্যুভীত অদৃষ্টবাদীদের জন্য এটাই বোধ করি শ্রেষ্ঠ অলৌকিক তত্ত্বকথা। অদৃষ্ঠের ধার ধারে নাই মানুষ কখনো, তাই মৃত্যুকে জীবন প্রিয়তার প্রতীক রূপে বিপ্লব আর জাগরণের সুর মূর্ছনার পরম্পরা সৃষ্ঠির উদ্দেশ্যেই গণজাগরণের চেতনায় আমাদের সাংস্কৃতিক আত্ম-পরিচয় সংকট উত্তরণ প্রয়োজন।
॥ তিন ॥
একুশের মৌলিক ভিত্তিকে যদি বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক চারিত্র্য, শিক্ষা ব্যবস্থাপনায় এককেন্দ্রিকতার প্রয়োজনীয়তা, রাজনৈতিকতার গণ-প্রতিষ্ঠা সম্ভব। সম্ভব সাংস্কৃতিক উত্থান – তাহলেই জাতিগত চেতনার অগ্রগতি এবং আত্ম-প্রসারণ সম্ভব।
লেখক: প্রাবন্ধিক ও গবেষক
2 thoughts on “একুশের চেতনা এবং আমাদের সাংস্কৃতিক আত্মপরিচয়”