১৩ অশুভ সংখ্যা

সত্যিই কি ১৩ অশুভ সংখ্যা?

জানা অজানা মিথলজি

আনলাকি থারটিন ! ১৩ সংখ্যাকে এই নামে অনেকে ডাকে। কিন্তু সত্যিই কি ১৩ অশুভ সংখ্যা ?

ইংরেজিতে ১৩ নম্বরটিকে ঘিরে অসংখ্য পৌরাণিক কাহিনী বা কুসংস্কার রয়েছে। এই সংখ্যাটিকে ভয় পাওয়ার একটি বিশেষ নামও রয়েছে। প্রাচীন গ্রিক ভাষায় এটি ‘ট্রিস্কাইডেকাফোবিয়া’ নামে পরিচিত। কিছু কিছু মানুষ, সমাজ ও দেশে এই ভীতি এতো প্রকট যে রীতিমতো তা মিথ এ পরিণত হয়েছে। অবশ্য এই কুসংস্কারের পিছনে কিছু ঐতিহাসিক এবং সাংস্কৃতিক ভিত্তিও আছে। এইসব বিশ্বাস ১৩ নম্বরটিকে দুর্ভাগ্যজনক ও অপয়া বলে প্রচলনে অবদান রেখেছে। বিশ্ব জুড়ে ১৩ নম্বরের সাথে যুক্ত অসংখ্য মিথ, ঘটনা, মজার গল্প, ভীতিকর সত্য এবং মূঢ় কুসংস্কার সেই প্রাচীন থেকে শুরু করে আজ এই বর্তমান বিজ্ঞানের যুগেও প্রচলিত। তবে মূদ্রার অপর পিঠও রয়েছে। কেউ কেউ যখন এই সংখ্যাটিকে একটি অশুভ লক্ষণ বলে মনে করে যখন ইতালি এবং থাইল্যান্ডের মতো কিছু দেশে এটি তাদের ভাগ্যবান সংখ্যা হিসাবে গণ্য করে। তাই ১৩ সংখ্যাটি শুভ নাকি অপয়া এ নিয়ে পরস্পরবিরোধী মতবাদও প্রকট! কিন্তু কেন ১৩ সংখ্যাটাকে অপয়া বা অশুভ হিসাবে মনে করা হয়? তাহেলে চলুন এর পিছনের ইতিহাসটা জেনে নেয়া যাক।

যেসব কারণে ১৩-কে আনলাকি বা অপয়া বলে মনে করা হয়

দ্য লাস্ট সাপার

ধারণা করা হয়ে থাকে, ১৩ সংখ্যার সাথে সবচেয়ে প্রচলিত আনলাকি (unlucky 13) মিথটি খ্রিস্টধর্ম থেকে এসেছে। বাইবেল অনুসারে, যীশু তাঁর ১২ জন শিষ্যের সাথে শেষ নৈশভোজে অংশ নেন। কিন্তু দেখা যায় সেখানে ১৩ জন ব্যক্তি উপস্থিত আছেন। জুডাস ইসকারিওট ছিলেন সেই তেরোতম যিনি টেবিলে বসেছিলেন। এই জুডাস পরে যীশুর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলো। তারপর থেকে ১৩ সংখ্যাটি একটি নেতিবাচক ও দুর্ভাগ্যজনক সংখ্যা হয়ে দাঁড়ায়। আবার কেউ কেউ মনে করেন লাস্ট সাপার গ্রহণ করা হয়েছিল নিসান মাসের ১৩ তারিখে। নিসান হলো ইহুদী ক্যালেন্ডারের একটি মাস। আর কেউ কেউ বলেন যীশুর ক্রুসবিদ্ধকরণের তারিখও নাকি ছিল ১৩ নিসান।
Unlucky 13
The Last Supper

তেরোজনের সাথে খাবার খাওয়া অশুভ

লাস্ট সাপারে ঘটনার পর থেকে অনেকে এমনও মনে করে যে, ১৩ জন একসাথে ডিনারে বসলে ১ বছরের মধ্যে একজন মারা যেতে বাধ্য। এই বিশ্বাসের ব্যাপক প্রচলন আজও বিদ্যমান। যার জলন্ত প্রমাণ লন্ডন, ইংল্যান্ডের স্যাভয় হোটেলে ডিনারের ব্যবস্থা। সে হোটেলের বিষয়টি এরকম, যদি আপনি তেরো জনের জন্য একটি টেবিল বুক করেন, তবে টেবিলটি ডিফল্টভাবে চৌদ্দজনের জন্য সেট করা হবে এবং ১৩ তম স্থানটি ক্যাসপার নামে একটি কালো বিড়ালের একটি ভাস্কর্য দ্বারা দখল করে রাখা হয়। কেননা পশ্চিমা সংস্কৃতিতে তেরোজনের সাথে খাবার খাওয়াকে অশুভ বলে মনে করা হয়।

১৩ তম শুক্রবার

পাশ্চাত্য দেশে ১৩ তারিখ শুক্রবার নিয়ে ব্যাপক কুসংস্কার রয়েছে। শুক্রবারের সাথে ১৩ নম্বরের এ সংমিশ্রণটি তারা বিশেষ অশুভ বলে করে। কোনও মাসের ১৩ তারিখ যদি শুক্রবার হয় তবে ইউরোপের মানুষজন ভয় পেয়ে যান। কারণ, অনেকের মতে যীশুকে যে-দিন ক্রশবিদ্ধ করা হয় সে দিন ছিল শুক্রবার। তাই তারা এই দিনকে দুর্ভাগ্যজনক দিন বলে মনে করে। ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায় ১৩ তারিখের শুক্রবারগুলিতে পৃথিবীতে নানা ধরনের বিপর্যয় এসেছে। তাই ক্যালেন্ডারে ১৩ তারিখ শুক্রবার হলে কিছু লোক এই দিনে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া, ভ্রমণ করা বা গুরুত্বপূর্ণ ক্রিয়াকলাপে জড়িত হওয়া এড়িয়ে যায়। এই দিন লোকেরা বাড়িতে থাকতে পছন্দ করে। আর ১৩ তম শুক্রবার নিয়ে এই ভয়কে ডাকা হয় প্যারাস্কেভিডেকাট্রিয়াফোবিয়া বলে।

সাংস্কৃতিক কুসংস্কার

পশ্চিমা সংস্কৃতিতে, বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপে, অনেক উঁচু বিল্ডিং, হোটেল এবং হাসপাতালের বিল্ডিং ফ্লোর নম্বরিং এর বেলায় প্রায়শই ১৩ তলা বা নম্বরটি এড়িয়ে যায়। কিছু বিল্ডিং সরাসরি ১২ তলা থেকে ১৪ তলা পর্যন্ত যায়। এমন কি হোটেলে কোন রুম # 13 নম্বরও দেয় না। তারা সেখানে ১২ নম্বারের পর ১৩ সংখ্যার পরিবর্তে ১২/বি ব্যবহার করে। আগে বিমানে ১৩ নম্বরের কোনও সিট থাকত না।

 

ইউরোপ বা বিশেষ করে আমেরিকায় বহুতল ভবনের লিফটে ১৩ নম্বরের কোনও সুইচ থাকে না। ১৩ কে অশুভ মনে করে ক্রেতাকে চিন্তামুক্ত রাখতে তারা এই টেকনিক ব্যবহার করে। আরো দেখা যায়, কোন কোন খেলোয়ার তাদের জার্সিতে ১৩ নম্বার ব্যবহার করতে রাজী হয় না। অপরদিকে ইউরোপে এক সমীক্ষায় দেখা গেছে ১৪ তারিখে প্রকাশিত পত্রিকাগুলোতে তুলনামূলক বেশি ঘটনা-দূর্ঘটনার খবর পাওয়া যায়।

 

Apollo 13 মিশন

শুধু পুরাণেই নয়, বিজ্ঞানের ক্ষেত্রেও ১৩ সংখ্যার প্রভাব দেখা যায়। Apollo 13 আমেরিকানদের একমাত্র অসফল মিশন ছিল। এর কারণ বলে অনেকে এর দুর্ভাগ্যজনক সংখ্যা 13 নম্বারকে মনে করে। ১৯৭০ সালে ১১ এপ্রিল Apollo 13 দুপুর ১টা ১৩মিনিটে (১৩:১৩) তার যাত্রা করেছিল। ১৩ এপ্রিল এর অক্সিজেন ট্যাঙ্ক বিস্ফোরিত হয়ে একটি গুরুতর পরিস্থিতির সৃষ্টি হলে ‘অ্যাপোলো ১৩’ আবার ফিরে আসে এবং মিশনটি বাতিল হয়। এই প্রেক্ষাপটে “Houston, we have a problem” কথাটি বিখ্যাত হয়ে ওঠে এবং 13 নম্বরটি সবার মনোযোগ আকর্ষণ করে। এই ঘটনা থেকেই বিজ্ঞানীদের মনে ধারণা জন্মায়, ১৩ সংখ্যাটি তাঁদের জন্য অশুভ। এর পর তাঁরা কোনও নতুন মিশনের জন্য স্যাটেলাইট বা রকেট লঞ্চ করলে ১৩ নম্বরটি এড়িয়ে গিয়ে অন্য নম্বর দিয়ে নামকরণ করতেন।

সংখ্যাতত্ত্ব এবং ট্যারো

সংখ্যাতত্ত্বে ১৩ নম্বরটি উত্থান, রূপান্তর এবং পরিবর্তনের প্রতীক ধরা হয়। ভাগ্য গণনার জন্য বহু বছরের পুরোনো যে অশুভ ট্যারট কার্ড রয়েছে তার মোট ৭৮টি কার্ডের ভিতরে ১৩ নম্বর কার্ডটির মানে হল মৃত্যু! ট্যারোট ভাষায়, ১৩ নম্বরটি মৃত্যু কার্ড হিসাবে পড়া হয়। যা আক্ষরিক মৃত্যুর পরিবর্তে রূপান্তর এবং পুনর্জন্মের প্রতীক।

স্ক্যান্ডেভিয়া মিথ-এ ১৩

স্ক্যান্ডেভিয়া ভাইকিং যোদ্ধাদের অপদেবতার নাম ছিল লোকি এবং তার নম্বর ছিল ১৩। নর্সের পুরাগাথা অনুযায়ী, ভালহাল্লার হলঘরে ১২ জন দেবতা নৈশভোজের উদ্দেশে বসেছিলেন। কিন্তু সেখানে ‘লোকি’কে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। রাগের বশে ছলচাতুরি করে তিনি এক দেবতাকে বশীভূত করে তাঁকে দিয়ে অন্য দেবতাকে মেরে ফেলেন। তাই স্ক্যান্ডেভিয়ানদের কাছে ১৩ সংখ্যাটি অশুভ।

ফর্মুলা 1-এর কুসংস্কার

ফর্মুলা 1-এ, ১৩ নম্বরযুক্তহ কোনও গাড়ি নেই। কারণ এটিকে কর্তৃপক্ষ দূর্ভাগ্য বলে বিবেচিত করে।

ডাইনিদের প্রিয় সংখ্যা

ডাইনিদের সমাবেশকে কভেন বলা হয়, যেখানে ১৩ জন ডাইনি উপস্থিত থাকে। সেখানে এ সংখ্যা কখনও বদলায় না। এ কারণেও ১৩ সংখ্যাটি অশুভ।

মাইক্রোসফ্ট এর ১৩ সংখ্যা বর্জন

অতি সম্প্রতি মাইক্রোসফ্ট এর একটি ঘটনা ১৩ নম্বরটিকে দুর্ভাগ্যজনক বলে উচকে দিয়েছে। তারা তাদের অফিস সংস্করণ ১২ এর পরে ১৪ সংস্করণ নিয়ে এসেছে। তারা ১৩ এড়িয়ে গেছে কারণ তারা ধরে নিয়েছে যে এটি তাদের ব্যবসার জন্য ততটা শুভ হবে না।

কুখ্যাত খুনীদের সাথে ১৩ সংখ্যার সম্পর্ক

কুসংস্কার প্রচলিত আছে যে কারো নামে যদি ১৩ অক্ষর থাকে, তবে সে অভিশপ্ত হয়ে থাকে। কাকতালীয় শোনালেও বেশ কয়েকজন কুখ্যাত খুনীদের নাম, যেমন: চার্লস ম্যানসন (Charles Manson), জ্যাক দ্য রিপার (Jack the Ripper), জেফরি দামের (Jeffrey Dahmer), থেডর বানডি (Theodore Bundy) এবং আলবার্ট ডি স্যালভো (Albert De Salvo) তাদের নামে ১৩ অক্ষর ধারণ করেছিল।

 

যাদের কাছে ১৩ সংখ্যাটি সৌভাগ্যের প্রতীক

১. মাইমোনাইডস অনুসারে ইহুদি বিশ্বাসের ১৩টি নীতি রয়েছে। তাই এটি তাদের কাছে সৌভাগ্যের প্রতীক।
২. প্রাচীন গ্রীসে, জিউসকে ত্রয়োদশ এবং সবচেয়ে শক্তিশালী দেবতা হিসাবে বিবেচনা করা হয়। এই ত্রয়োদশ দেবতা সমগ্রতা, পূর্ণতা এবং অর্জনের সাথে যুক্ত বলে মনে হয়।
৩. অনেক ধর্ম বিশ্বাসে অনন্তকালের সিঁড়িটির তেরো ধাপ রয়েছে বলে মনে করা হয়। ১৩ তম ধাপে পৌঁছালে কারো আত্মা আধ্যাত্মিক পূর্ণতা লাভ করে বলে ধরে নেওয়া হয়।
৪. ১৩ হল একটি মৌলিক সংখ্যা, যার মানে এটি নিজে ছাড়া অন্য কোন সংখ্যা দ্বারা ভাগ করা যায় না। অতএব, ১৩ অক্ষয় প্রকৃতি এবং বিশুদ্ধতার গুণাবলীর প্রতীক।
৫. কোন কোন দেশে এই সংখ্যাকে শুভ মানা হয়। ফ্রান্স এবং ইটালিতে কোনও শুভ বার্তা পাঠাতে হলে পোস্টকার্ডের উপর ১৩ সংখ্যাটি লেখা হয়।
৬. থাই নববর্ষ (সংক্রান দিবস) ১৩ এপ্রিল পালিত হয়। এটি মানুষ, বন্ধুবান্ধব এবং আত্মীয়দের উপর জল ছিটিয়ে সমস্ত অশুভ লক্ষণ ধুয়ে ফেলার দিন হিসাবে বিবেচিত হয়।
৭. এথেন্স অলিম্পিক গেমসের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ১৩ আগস্ট ২০০৪ সালে অনুষ্ঠিত হয়।
৮. আমরা সবাই জানি, ১৩ বছর বয়স হচ্ছে প্রতিটি মেয়ে বা ছেলের বয়োসন্ধি পরিবর্তন বা পরিবর্তনের সময়কাল। এটি সেই বয়স যখন শিশুরা আনুষ্ঠানিকভাবে কিশোর হয়।
৯. মার্কিন পতাকায় ১৩টি স্ট্রিপ রয়েছে, যা ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য ১৩ টি উপনিবেশের মিলনকে প্রতিনিধিত্ব কর। পরে এই ১৩টি উপনিবেশ আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম তেরোটি রাজ্যে পরিণত হয়।
১০. হিন্দু পুরাণে, মহা শিবরাত্রি মাঘ মাসের ত্রয়োদশ রাতে পালিত হয়, যা সমস্ত শিব ভক্তদের জন্য অত্যন্ত পবিত্র এবং একটি পবিত্র রাত।
১১. শিখদের পবিত্র গ্রন্থ “গুরু গ্রন্থ সাহিব”, “ওয়াহেগুরু” শব্দটি যার অর্থ অনন্ত গুরু ১৩ বার এসেছে।
এই ছিল ১৩ নম্বর সম্পর্কে শুভ-অশুভের আলোচনা। প্রতিটি সংখ্যার নিজস্ব তাৎপর্য এবং গুরুত্ব রয়েছে। এখন কে কীভাবে কোন সংখ্যাটি গ্রহন করবে এটা আসলে তার নিজস্ব বিষয়। সংখ্যার সাথে সম্পর্কিত কুসংস্কারগুলি আসলে কিছু কিছু মানুস ও সমাজের সাংস্কৃতিক চর্চা। বাস্তবে এর ভিত্তি নেই। আর ১৩ সংখ্যাটি দুর্ভাগ্যজনক হওয়ার ধারণাটির বৈজ্ঞানিক প্রমাণের অভাব রয়েছে। যদিও কিছু লোক ট্রিস্কাইডেকাফোবিয়াকে গুরুত্বের সাথে নেয়, অন্যরা এটিকে কোনো বাস্তব ভিত্তি ছাড়াই নিছক কুসংস্কার বলে উড়িয়ে দেয়। পরিশেষে বলা যায়, এই ১৩ সংখ্যাটি শুভ না অশুভ বলে বিবেচিত হবে তা পুরোপুরি নির্ভর করে কারো ব্যক্তিগত দৃষ্টিকোণের উপর। কুসংস্কারকে গুরুত্ব সহকারে নিলে এক কথা, অপরদিকে ঘটনা বা ফলাফলের উপর কোন বাস্তব প্রভাব ছাড়াই সেগুলিকে নিছক লোককাহিনী হিসাবে দেখাও যেতে পারে।

Sharing is caring!

Shajahan Manik

ইংরেজি প্রভাষক শাহ্জাহান মানিক একাধারে কবি, লেখক, গবেষক ও অনুবাদক। একাধিক কাব্যগ্রন্থ ছাড়াও তার অনুদিত বইয়ের সংখ্যা ১০টি। এছাড়া সায়েন্স ফিকশন, সম্পাদনা, ছোটদের বইয়ের পাশাপাশি তার রয়েছে ইংরেজি শেখার বই। তার সর্বশেষ প্রকাশিত গ্রন্থ হচ্ছে- মানব কল্যাণে মুসলিম বিজ্ঞানীদের অবদান।

https://besorgo.com

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *