‘বিদ্রোহী’ র মিথমালা
কাজী নজরুল ইসলামের ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি বহু ধারার মিথের মিথষ্ক্রিয়ার এক অনবদ্য রূপ।
প্রমথ চৌধুরীর ‘সবুজপত্র’ (১৯১৪) পত্রিকার সূচনা সংখ্যায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘সবুজের অভিযান’ কবিতাটি প্রথম প্রকাশিত হয়। ‘সবুজের অভিযানে’ কবিগুরুর আহ্বান ছিল-
‘ওরে নবীন, ওরে আমার কাঁচা
ওরে সবুজ, ওরে অবুঝ,
আধ-মরাদের ঘা মেরে তুই বাঁচা।’
কবিগুরুর আহ্বানের আট বছর পরে ৬ জানুয়ারি ১৯২২ খ্রি. নলীনিকান্ত সরকার সম্পাদিত সাপ্তাহিক ‘বিজলী’ পত্রিকার মাধ্যমে কাজী নজরুল ইসলাম বাংলার কাব্যাকাশে অধিষ্ঠিত হলেন এবং ঘা মারার এক অভিনব কাব্যাস্ত্রের ঝিলিক দেখালেন―যার নাম ‘বিদ্রোহী’। তাঁর আবির্ভাব অনেকটা ‘ঝড়ের মাতন বিজয়-কেতন নেড়ে/ অট্টহাস্যে আকাশখানা ফেড়ে’। কবিগুরু যেমন বলেছিলেন, ‘হঠাৎ আলো দেখবে যখন/ ভাববে, একি বিষম কান্ডখানা’, ঠিক তেমনি তখনকার পাঠক সমাজ অবাক হয়েই ২২ বছর বয়সী ‘নবীন’ কবি নজরুলের ‘বিষম কান্ডখানা’ দেখে ভাবনায় পড়েছিল এবং ভাবনার রেশ কাটিয়ে উঠে করতালি দিয়ে তাঁকে বিদ্রোহী কবি হিসেবে স্বাগত জানিয়েছিল।
১৯২২ খ্রিষ্টাব্দেই প্রকাশিত হলো কাজী নজরুল ইসলামের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘অগ্নিবীণা’―যে বীণার অদৃশ্য তারে বেজে ওঠে তেজোময় সুর। যে সুরে জেগে ওঠে নিস্তেজ প্রাণ, যে প্রাণে জেগে ওঠে নতুন সৃষ্টির উন্মাদনা, যে উন্মাদনা ‘প্রলয়োল্লাস’ করতে করতে ‘বজ্রশিখার মশাল জ্বেলে’ ভয়ঙ্কর রূপে আবির্ভূত হয়ে জানিয়ে দেয় বিদ্রোহী গণমানুষের প্রতীক এক বিশাল ‘আমি’র অস্তিত্বকে। প্রচলিত অন্ধকার ব্যবস্থার মূলোৎপাটন করতে মহাবিদ্রোহী রূপে আবির্ভূত কবির ‘বিদ্রোহী’ কবিতা শতবছর ধরে ঝিমিয়ে পড়া প্রাণকে সতেজ করতে প্রেরণা যুগিয়ে যাচ্ছে নিরন্তর। শতবছর পরেও পাঠকের ভাবনায় ‘বিদ্রোহী’ কবিতা সম্পূর্ণ নতুন রূপে আবির্ভূত হয়ে বিদ্রোহের সুর অক্ষুন্ন রেখেছে এবং কবির কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে সচেষ্ট রয়েছে।
‘বিদ্রোহী’ এমন একটি কবিতা যার পঙক্তিতে পঙক্তিতে রয়েছে ঝাঁজালো আগুন, পাশাপাশি রয়েছে স্নিগ্ধ-কোমল অনুভূতির পরশ। কবি তাঁর অনুভূতির গাঢ়ত্বকে উৎকর্ষ মন্ডিত করতে ব্যবহার করেছেন প্রাচীনকালের চিন্তকদের রচিত নানা উপাখ্যানের বিন্দু-সিন্ধু চিরায়ত উপকরণ। এ কবিতায় প্রাচীন কবিদের ভাবনার সাথে বিদ্রোহী কবির ভাবনার মাধুর্যে সৃষ্টি হয়েছে অপূর্ব মিথমালা। বর্তমান আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু এই মিথমালা তথা বারোয়ারি কিংবদন্তি।
একশত একচল্লিশ পঙক্তির ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় কবি পরাধীন ভারতবর্ষের গণ – ‘অচেতন-চিতে চেতন’ দিতে গণমানুষের বহুলচর্চিত পুরাণকথার পুনঃপুন উল্লেখ করেছেন। এ কবিতায় কবি পুরাণ উপকরণ সংগ্রহ করছেন ভারতীয়, আরবীয় এবং ইউরোপীয় ঐতিহ্য থেকে। তবে ভারতীয় হিন্দু-পুরাণ ঐতিহ্যকেই ব্যবহার করেছেন সবচেয়ে বেশি।
‘বিদ্রোহী’ কবিতায় ভারতীয় হিন্দু-পুরাণ মিথের ব্যবহার
বিদ্রোহী কবির বিদ্রোহী চেতনার প্রতীক হিসেবে উল্লেখযোগ্য স্থান জুড়ে আছে রুদ্র- তথা শিব। সনাতন বাঙালির কাছে শিব অত্যন্ত জনপ্রিয়। তিনি একদিকে যেমন সংযমী অন্যদিকে তেমনি মহাতেজা। প্রাগার্য বলে তিনি দক্ষের যজ্ঞানুষ্ঠানে বর্জিত হয়েছিলেন। পিতা দক্ষের যজ্ঞানুষ্ঠানে স্বামী শিবের নিন্দা শুনে সতী দেহত্যাগ করলে মহাতেজা মহাদেবের রৌদ্ররূপ আমন্ত্রিত দেবগণ দেখেছিলেন। সংহার মূর্তি ধারণ করে দক্ষের যজ্ঞানুষ্ঠান তছনছ করে দিয়েছিলেন। সৃষ্টি-স্থিতি ও বিনাশের প্রতীক মহাদেবের এই রৌদ্ররূপ গণ-আমিত্বের বিদ্রোহী চেতনায় ‘মম ললাটে রুদ্র ভগবান’ হিসেবে আবির্ভূত হলো ‘বিদ্রোহী’ কবিতায়। পাঠক সমাজ দেখল এক তেজোময় আমিত্ব।
মহাদেব সঙ্গীত বিদ্যায় পারদর্শী ছিলেন। তাঁর সঙ্গীতবিদ্যা দিয়ে নাকি নারদমুনিকেও পরাস্ত করেছিলেন। মহাদেব মহাপ্রলয়ের সময় তান্ডবনৃত্য করেছিলেন। গজাসুর ও কালাসুরকে বধ করেও তিনি তান্ডব নাচ নেচেছিলেন। তান্ডব নৃত্যকলার উদ্ভাবক হিসেবে তিনি ‘নটরাজ’। তাই দেবাদিদেব মহাদেবের রূপক ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় বারবার ব্যবহৃত হয়েছে। লিঙ্গপুরাণে বর্ণিত মহাদেবের সহস্র নামের মধ্যে অনেকগুলো নাম ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় রূপক প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে।
রুদ্র, ভগবান, চন্দ্র, সূর্য, শনি, রাহু, কেতু, মহানাদ, নৃত্য-পাগল, বিষ্ণু, যজ্ঞ, দুর্বাসা, দর্প, ভীম সবকটি নামই যথাযথ ভাবের প্রতিনিধিত্ব করেছে ‘বিদ্রোহী’তে। নটরাজ, ধূর্জটী, কৃষ্ণকণ্ঠ, ব্যোমকেশ, পিনাক, রুদ্র ইত্যাদি নাম বিশেষণের পিছনে রয়েছে তাৎপর্যপূর্ণ গল্প। এসব পৌরাণিক গল্পের ভাবের সার্থক রূপায়ন ঘটেছে ‘বিদ্রোহী’ কবিতায়। যেমন:
* মম ললাটে রুদ্র ভগবান জ্বলে রাজ রাজ টীকা দীপ্ত জয়শ্রীর!
* মহাপ্রলয়ের আমি নটরাজ!
* আমি ধূর্জটী
* আমি কৃষ্ণকণ্ঠ, মন্থন-বিষ পিয়া ব্যথা-বারিধির।
* আমি ব্যোমকেশ, ধরি বন্ধন-হারা ধারা গঙ্গোত্রীর।
* আমি পিনাক-পাণির ডমরু ত্রিশূল।
এছাড়া অন্য পৌরাণিক গল্পের আশ্রয়গুলোও রূপক-উপমায় একেকটি বুলেট হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। ‘আমি ভীম ভাসমান মাইন’। ভাসমান বিস্ফোরক শক্তির তীব্রতা হিসেবে মহাভারতের প্রবল শক্তিশালী ভীম চরিত্রটি কীভাবে কবির কাছে প্রাসঙ্গিক বিবেচিত হলো তার গল্পটি এখানে বলা যায়। পাণ্ড পুত্র ভীম যিনি বাল্যকালে গঙ্গাতীরের প্রমাণকোটি নামক স্থানে জলক্রীড়া করতে গিয়ে দুর্যোধনের দুশমনিতে বিষমিশ্রিত খাদ্য খেয়ে বিষক্রিয়ায় অচেতন হয়ে পড়েন। পাপমতি দুর্যোধন তাকে লতা দিয়ে বেঁধে জলে ফেলে দেয়। ভীম অচেতন অবস্থায় জলে নিমগ্ন হয়ে নাগলোকে প্রবেশ করে। মহাবিষ সর্পগণের দংশনে ভীমের শরীরে থাকা কালকুট বিষের ক্রিয়া নষ্ট হয়। নাগরাজ বাসুকি ভীমকে চিনতে পেরে তাকে রসায়ন পান করতে দেন। রসায়ন পান করে ভীম টানা আটদিন ঘুমিয়ে থাকেন। চেতন হলে নাগগণ তাকে জানান, ‘রসায়ন জীর্ণ করে তুমি অযুত হস্তীর বল পেয়েছ। এখন দিব্যজলে স্থান করে ঘরে যাও।’১ ভীম মহাবলশালী হলেন। কবির বিদ্রোহী চেতনা সেই মহাবলী ভীমের সাথে তুলনীয় হয়ে শিল্পরূপ পায়।
মহাভারতে জমদগ্নি চরিত্রটি ক্রোধী হিসেবে পরিচিত। পান থেকে চুন খসলেই তিনি রাগান্বিত হয়ে যেতেন। তার স্ত্রী রেণুকার মানসিক স্খলন টের পেয়ে তিনি এতটাই রাগান্বিত হয়েছিলেন যে পুত্র পরশুরামকে দিয়ে মাতৃহত্যা করিয়েছিলেন। কেন? রেণুকার অন্যায়ের মাত্রাটা ছিল এরকম: ‘একদিন রেণুকা স্নান করতে গিয়ে দেখলেন মার্তিকাবত দেশের রাজা চিত্ররথ তার পত্নীদের সঙ্গে জলক্রীড়া করছেন। চিত্তবিকারের জন্য বিহ্বল ও ত্রস্ত হয়ে রেণুকা আদ্রদেহে আশ্রমে ফিরে এলেন। পত্নীকে অধীর ও ব্রাহ্মীশ্রী বর্জিত দেখে জমদগ্নি ধিক্কার দিয়ে ভর্ৎসনা করলেন এবং তাকে হত্যা করার জন্য পুত্রদের একে একে আজ্ঞা দিলেন। মাতৃস্নেহে অভিভূত হয়ে চারপুত্র নীরবে রইলেন। জমদগ্নি রাগান্বিত হয়ে তাদের অভিশাপ দিলেন। তারা পশুপক্ষীর ন্যায় জড়বুদ্ধি হয়ে রইলেন।
তারপর পরশুরাম আশ্রমে এলে জমদগ্নি তাকে বললেন, পুত্র, দুশ্চরিত্রা মাতাকে বধ কর, ব্যথিত হয়ো না। পরশুরাম কুঠার দিয়ে তাঁর মাতার শিরচ্ছেদ করলেন। জমদগ্নি প্রসন্ন হয়ে বললেন, আমার আজ্ঞায় তুমি দুষ্কর কর্ম করেছ, তোমার বাঞ্ছিত বর চাও। পরশুরাম এই বর চাইলেন―‘মাতা জীবিত হয়ে উঠুন, তাঁর হত্যার স্মৃতি যেন না থাকে, আমার যেন পাপ স্পর্শ না হয়, আমার ভ্রাতারা যেন তাদের স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে পান, আমি যেন যুদ্ধে অপ্রতিদ্বন্দ্বী হই এবং দীর্ঘায়ু লাভ করি। জমদগ্নি এই সকল বর দিলেন।’২ অন্যায়ের বিরুদ্ধে যজ্ঞাগ্নির মতো সর্বদা ক্রোধে জ্বলতে থাকা জমদগ্নির ধ্বংস এবং সৃষ্টির গুণে গুণান্বিত চির-দুরন্ত কবির ঘোষণা ‘আমি সাগ্নিক জমদগ্নি’।
মহাভারতের সবচেয়ে রগচটা মুনি হিসেবে খ্যাত দুর্বাসা। তিনি মহাদেবের রৌদ্রগুণের অধিকারী। কথায় কথায় রেগে গিয়ে অভিশাপ দিতেন। অভিশাপ যাকে দিতেন তিনি প্রকৃতপক্ষে অভিশপ্ত হওয়ার মতো কাজ করেছেন কি না তা তলিয়ে দেখতেন না। এ কারণে তিনি ক্ষ্যাপা দুর্বাসা হিসেবে পরিচিত। বিদ্রোহীর একটি বৈশিষ্ট্য পরিষ্কার করার জন্য তিনি দুর্বাসাকেই প্রতীক হিসেবে এনেছেন। ভারতীয় ঐতিহ্যের এরূপ মিথগুলো প্রতীকী ও রূপকার্থে প্রজ্জ্বলিত নিম্নোক্ত পঙক্তিগুলোতে। যেমন-
* আমি ইন্দ্রাণী-সুত হাতে চাঁদ ভালে সূর্য,
* আমি ক্ষ্যাপা দুর্বাসা- বিশ্বামিত্র শিষ্য,
* ধরি বাসুকির ফণা জাপটি
* আমি ছিনিয়া আনিব বিষ্ণু-বক্ষ হইতে যুগল কন্যা!
* আমি শনি,
* আমি ছিন্নমস্তা চণ্ডী,
* আমি পরশুরামের কঠোর কুঠার
* আমি হল বলরাম-স্কন্ধে,
* আমি বিদ্রোহী ভৃগু, ভগবান বুকে এঁকে দেই পদচিহ্ন
‘বিদ্রোহী’ কবিতায় ভারতীয় মুসলিম মিথের ব্যবহার
কবি বিষয় ভাবনার সাথে সঙ্গতি রেখে ভারতীয় পুরাণের পাশাপাশি আরবীয় মুসলিম পুরাণ ঐতিহ্যকে অত্যন্ত দক্ষতার সাথে ব্যবহার করেছেন। ‘আমি চির উন্নত শির’ বোঝাতে তিনি বেহেশ্তের সর্বোচ্চ স্থান ‘খোদার আসন ‘আরশ’কে চেতনায় অতিক্রম করেছেন। বিদ্রোহী চেতনা ‘ইস্রাফিলের শিঙ্গার মহা-হুঙ্কার’এ আবির্ভূত হয়ে সকল নিকৃষ্ট অবস্থা-ব্যবস্থার অপসারণে মহাপ্রলয় ঘটাবে―ঠিক যেন কেয়ামতের মতোই। কেয়ামতের চেয়ে ভয়াবহ অবস্থা আর কী হতে পারে! অতএব, নিকৃষ্ট পদ্ধতির প্রবর্তকেরা সাবধান! বিদ্রোহীর আগমনের গতি হবে বেগবান তেজিয়ান ঘোড়া ‘তাজী বোররাক’ এর বিদ্যুৎ গতির ন্যায়। ইসলামি কেতাব ঐতিহ্য থেকে আগত এসব মিথ-পুরাণ যেন নতুন অর্থে দীপ্ত হয়ে উঠেছে কবির সফল পরিবেশনায়। ‘বিদ্রোহী’ কবিতার নিম্নোক্ত পঙক্তিগুলো ইসলাম ধর্মীয় অনুষঙ্গবিশিষ্ট। যেমন:
* খোদার আসন ‘আরশ’ ছেদিয়া,
* আমি ইস্রাফিলের শিঙ্গার মহা-হুঙ্কার,
* তাজী বোররাক আর উচ্চৈঃশ্রবা বাহন আমার
* ধরি স্বর্গীয় দূত জিব্রাইলের আগুনের পাখা সাপটি!
* আমি রুষে উঠে যবে ছুটি মহাকাশ ছাপিয়া,
ভয়ে সপ্তনরক হাবিয়া দোজখ নিভে যায় কাঁপিয়া কাঁপিয়া!
* আমি জাহান্নামের আগুনে বসিয়া হাসি পুষ্পের হাসি!
‘বিদ্রোহী’ কবিতায় গ্রিক পুরাণ ও মিথের ব্যবহার
‘আমি অর্ফিয়াসের বাঁশরী’। গ্রিক পুরাণের সর্বশ্রেষ্ঠ মানব সুর স্রষ্টা এবং বংশীবাদক হলেন অ্যাপলো দেবতার পুত্র অর্ফিয়াস। তিনি বাঁশিতে যখন সুর তুলতেন তখন তাঁর সুর শুনে স্তব্ধ হয়ে যেত জীবকুল, বদলে যেত নদীর গতিপথ, শিকড়-বাকড় ছিঁড়ে গাছপালা পর্যন্ত সুরের সাথে সাথে এগিয়ে চলত, পাথরের বুক চিরে কান্না ঝরে ঝরে পড়ত, যুদ্ধরত দেবতারা যুদ্ধ থামিয়ে তার বাঁশির সুর শুনতেন, ঝরে যাওয়া ফুলও আবার হেসে উঠত। এমনই ছিল অর্ফিয়াসের বাঁশির সুর, এমনি করেই মোহিত হতো সবাই।৩ এমনই এক কৃষ্ণের বাঁশির সুরে পাগলপারা ভারতীয় পুরাণের রাধা। ‘কে বাজাইয়া যাওরে বাঁশি রাজপন্থ দিয়া/ রাধার প্রাণটি নিল বাঁশিটি বাজাইয়া।’৪ নজরুল যখন তাঁর বিদ্রোহী চেতনার বিপরীতে কোমল রাগিনীতে সুর তুলেন তখন তাঁর ভাবের উপযুক্ত বাহন হয় গ্রিক পুরাণের ‘অর্ফিয়াসের বাঁশরী’―যার সাথে সাথে ভারতীয় পুরাণের ‘শ্যামের হাতের বাঁশরী’কেও স্মরণ করতে ভুলেন না কবি। এভাবেই গ্রিক-ভারতীয় বাঁশির সুরে মিশে গিয়ে তিনি হয়ে যান আধুনিক যুগের পৌরাণিক বংশীবাদক।
‘বিদ্রোহী’ কবিতায় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত ও ছন্দের ব্যবহার
কিংবদন্তি আছে যে, নজরুল তিন হাজারেরও বেশি গান রচনা করেছেন। ছোটবেলায় লেটোর দলে কাজ করার সময় থেকেই গান রচনায় হাত দেন। সঙ্গীতের প্রায় সব শাখাতেই তাঁর বিচরণ। তিনি নতুন সুর সৃষ্টি করেছেন। রাগ-রাগিনী নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন। সঙ্গীতজ্ঞ নজরুল ‘বিদ্রোহী’ কবিতায়ও এই ছাপ রেখেছেন। ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় তিনি যখন বলেন―
আমি নৃত্য পাগল ছন্দ,
আমি আপনার তালে নেচে যাই, আমি মুক্ত জীবনানন্দ,
আমি হাম্বীর, আমি ছায়ানট, আমি হিন্দোল,
আমি চল-চঞ্চল, ঠমকি-চমকি
ফিং দিয়া দিই তিন দোল!
আমি চপলা-চপল হিন্দোল।
তখন সঙ্গীতের ক্ষেত্রে তাঁর অবদানের কথাও স্মরণীয় হয়ে উঠে। উত্তর ভারতীয় সঙ্গীতশাস্ত্রে বর্ণিত ‘হাম্বীর’ একটি রাগের নাম―যার গতি চঞ্চল, চলন বক্র ও মীড়যুক্ত। ‘ছায়ানট’ কল্যাণ ঠাটের অন্তর্গত রাগ বিশেষ। এর প্রকৃতি শান্ত ও গম্ভীর। বিলম্বিত সন্ধ্যা বা রাত্রি প্রথম প্রহরে এই রাগ পরিবেশিত হয়। ‘হিন্দোল’ রাগের প্রকৃতি শান্ত ও গম্ভীর। দিবা প্রথম প্রহরে পরিবেশিত হয় এই রাগ।’৫ উক্ত রাগ তিনটির বৈশিষ্ট্য ‘বিদ্রোহী’ কবিতার সাথে মিশে আছে। এটা নজরুল চরিত্রেরও একটি বিশেষ দিক। রাগ তিনটির মাধুর্য অনুভবের সময় ‘বিদ্রোহী’ কবিতা মিলিয়ে নিলে নজরুল মানস বিশেষভাবে ধরা পড়তে পারে। সঙ্গীতবোদ্ধা পাঠকের নিকট ‘হাম্বীর’, ‘ছায়ানট’, ‘হিন্দোল’ ভিন্নমাত্রা বহন করে।
রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক কলুষতার দরুন শোষিত-নিপীড়িতের আর্তনাদে ব্যথিত হৃদয়, শোষণ-বঞ্চনার প্রতি তীব্র ক্ষোভ তাঁকে মহাবিদ্রোহী করে তুলেছিল। এই বিদ্রোহ সমগ্র শোষিত-পীড়িত ভুক্তভোগীর গণবিদ্রোহে রূপ দিতে, এক সুন্দর সমাজ নির্মাণের স্বপ্নে বিভোর হয়ে অন্যায্যতার বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমে অশান্ত হলেন এবং ঘোষণা দিলেন―
আমি সেই দিন হব শান্ত,
যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না,
অত্যাচারীর খড়্গ কৃপাণ ভীম রণ-ভূমে রণিবে না―
বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত।
আমি সেই দিন হব শান্ত।
পৃথিবীতে যতদিন অন্যায় অত্যাচার অবিচার চলতে থাকবে ততদিন কবির বিদ্রোহও চলতে থাকবে। আজহার উদ্দিন খান নজরুল সাহিত্যের বিচার করতে গিয়ে বলেছিলেন, যে দুর্বার যৌবনের স্বপ্ন নিয়ে তিনি কবিতা লিখেছিলেন, গান গেয়েছিলেন, বাঙলাদেশে তাঁর আহ্বান ব্যর্থ হয়নি―উৎপীড়িত মানুষ নিজের দাবী আদায় করার জন্যে দিকে দিকে আজ মাথা তুলেছে, যাদের ব্যথা তাঁকে আহত করেছিল, কবিতা লেখার রসদ যুগিয়েছিল, তাঁর সে স্বপ্নসাধ আজ সার্থক হতে চলেছে।৬
‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি বহু ধারার মিথের মিথষ্ক্রিয়ার এক অনবদ্য রূপ
বাংলার বহু কবি-সাহিত্যিক হিন্দু-মুসলিম ঐতিহ্য সম্পর্কে প্রচুর জ্ঞান রাখেন কিন্তু নজরুল পূর্ববর্তী সময়ে তাদের সাহিত্যকর্মে এই দুই ঐতিহ্যের মিলন ঘটানোর চেষ্টা করেননি কেউই। এক্ষেত্রে নজরুলই প্রথম প্রয়াসী―যিনি হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের রীতিনীতি, সংস্কৃতি-সংস্কারকে আত্মস্থ করে, উভয়ের ঐতিহ্যকে সমান শ্রদ্ধায় তাঁর কাব্যে তুলে ধরেছেন। একই ভাবের প্রতীক হিসেবে হিন্দু-মুসলিম উভয় ঐতিহ্যের সুন্দর সমন্বয় সাধন করেছেন। যখন তিনি ধ্বংসের প্রচ- শক্তির কল্পনা করেছেন তখন ‘ইস্রাফিলের শিঙ্গার মহাহুঙ্কার’ ও ‘পরশুরামের কঠোর কুঠার’ এর মধ্যে কোনো তফাৎ দেখেননি। এমনকি তিনি যখন প্রচন্ড গতির কল্পনা করেছেন তখন তাঁর কাছে তীব্র গতির বাহন হিসেবে হিন্দু-মুসলিম দুই ঐতিহ্যের দুই স্বর্গীয় বাহন ‘তাজী বোররাক’ ও ‘উচ্চৈঃশ্রবা’কে ভাব প্রকাশের উপযুক্ত মাধ্যম মনে করেছেন। শুধু তাই নয় এই দুই উপাদানকে একই পঙক্তিতে সুচারু সমন্বয় করে বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। অনুরূপভাবে তিনি একই ভাব প্রকাশের জন্য দুই ঐতিহ্যের ভয়ঙ্কর দুই ঔপমিক ‘জিব্রাইলের আগুনের পাখা’ ও ‘বাসুকির ফণা’কে জাপটি ধরে তাঁর শক্তিমত্ততার পরিচয় দিয়েছেন। এসব পৌরাণিক ঐতিহ্যের সার্থক মিলন ঘটায় ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় অপূর্ব কাব্যরস সৃষ্টি হয়েছে।
কবি নজরুল কেবল কাব্যক্ষেত্রেই হিন্দু-মুসলিম ঐতিহ্যের সমন্বয় করেননি তিনি ব্যক্তি জীবনেও প্রমীলা সূত্রে সমন্বয় সাধন করেছেন। সন্তানদের নামকরণেও দুই ঐতিহ্যের সমন্বয় ঘটিয়েছেন। তাঁর বিদ্রোহ রাষ্ট্র, সমাজ ও শিল্পসাহিত্যের ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ নয় ব্যক্তি জীবনও এর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
সর্বপ্রকার অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ বিদ্রোহ ঘোষণা করতে কবি ঐতিহ্যবাহী যে মিথগুলোর আশ্রয় নিয়েছেন তা বিক্ষুব্ধ কবিমনের জ্বলন্ত আগুন প্রকাশে কিংবা রোমান্টিক কবিমনের স্নিগ্ধতা প্রকাশে খুবই সহায়ক হয়েছে। তাই বলা যায়, গোটা ‘বিদ্রোহী’ কবিতাই এক অভিনব মিথে রূপান্তরিত হয়ে চিরকালীন রূপ ধারণ করেছে।
তথ্যসূত্র:
১. রাজশেখর বসু, কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাসকৃত মহাভারত সারানুবাদ, ত্রয়োদশ মুদ্রণ: ১৪১৮, পৃ. ৫২।
২. রাজশেখর বসু, কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাসকৃত মহাভারত সারানুবাদ, ত্রয়োদশ মুদ্রণ: ১৪১৮, পৃ. ১৯১, ১৯২।
৩. মনোজিৎ কুমার দাস, অর্ফিয়াস ও ইউরিডিসের অমর প্রেমকাহিনী, শুভবাংলাদেশ, ২ আগস্ট ২০২১।
৪. লোকগান
৫. সঙ্গীততত্ত্ব- দেবব্রত দত্ত, পৃ.১৫৬, ১৬০, ১৬১।
৬. আজহার উদ্দিন খান- নজরুল সাহিত্যের বিচার।