বাংলা ঋতু-মাসের নামবিচার
– সাইমন জাকারিয়া
বাংলার প্রধান প্রাকৃতিক ও সাংস্কৃতিক পরিচয় ছয় ঋতু আর ১২ মাসের মধ্যে সীমাবদ্ধ। স্বতঃস্ফূর্তভাবে বাংলার গ্রামীণ মানুষের ঐতিহ্যগত সাংস্কৃতিক পরিচয়ের সন্ধানে তাই বারবার এ দেশের ষড়ঋতু ও বাংলা মাসের ওপর নির্ভর থাকতে বাধ্য হয়েছি। সম্ভবত সেই সূত্রেই একদিন আচম্বিতে অন্বেষণ করি বাংলা ঋতু-মাসের নামবিচার। বর্তমান প্রবন্ধে মুখরা তথা মৌখিকভাবে প্রাপ্ত সেই অর্জিত অন্বেষণের সঙ্গে প্রামাণ্য তথা আভিধানিক পাঠের একটি তুলনামূলক আলোচনা উপস্থাপন করা হলো।
প্রথমেই বলা যাক বাংলা ‘ঋতু’ শব্দটি সম্পর্কে। গ্রামীণ মানুষের মুখে শুনেছি, ‘রত’ থেকে ঋতু কথাটির উদ্ভব। তাঁদের মুখেই শুনেছি, ‘দুই দুই মাস নিয়ে এক এক পর্ব রত বলে দুই মাসে এক ঋতু।’ প্রখ্যাত বাংলা অভিধান-প্রণেতা হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর বঙ্গীয় শব্দকোষ-এ ঋতু শব্দটির অর্থ প্রদান করেছেন এভাবে, ‘পর্য্যায়গামী, বৎসরের ষড়ভাগের মাসদ্বয়াত্মক ভাগ—গ্রীষ্মাদি কাল’। এখানে ‘মাসদ্বয়াত্মক’ শব্দটির ভেতর দিয়ে গ্রামীণ মানুষের বলা ‘দুই দুই মাস এক এক পর্ব রত বলে দুই মাসে এক ঋতু’ কথাটির সমর্থন মিলছে বৈকি! একই সঙ্গে ‘ঋতু’ শব্দের অর্থ আরোপ ও ব্যবহারবিধির ব্যাখ্যা করতে গিয়ে চন্দ্রমোহন তর্করত্ন প্রণীত অমরকোষ-এর টীকার সাক্ষ্য মেনে হরিচরণ বলেছেন, ‘অগ্রহায়ণ হইতে দুই দুই মাস যথাক্রমে শিশির বসন্ত গ্রীষ্ম বর্ষা শরৎ হিম—বৎসরের এই ছয় ঋতু।’ একসময় অগ্রহায়ণ থেকে বাংলা বর্ষ গণনা শুরু হতো। অগ্রহায়ণের পর ধারাবাহিকভাবে শিশির অর্থ শীত, বসন্ত, গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ ও হিম তথা হেমন্ত দিয়ে বর্ষ গণনার সমাপ্তি ঘটত। হরিচরণ অমরকোষ-এর সাক্ষ্য মেনে বাংলা বর্ষ গণনার সেই পুরোনো ঋতু আবর্তনের প্রসঙ্গটি উল্লেখ করেছেন। অবশ্য, এর পাশাপাশি তিনি বাংলা ঋতু গণনার অন্য মতান্তরও উল্লেখ করেছেন।
গ্রীষ্ম
বাংলার প্রথম ঋতু গ্রীষ্ম। ‘গৃ+ইষ্ম=গ্রীষ্ম। ইষ্ম থিকে উষ্ম, আর উষ্ম থিকে উষ্ণ। উষ্ণ মানে গরম। আবার গৃ থিকে গৃহ, গৃহ থিকে গ্রহ, গ্রহ থিকে গ্রহণ, গ্রহণ থিকে গরম, গরম থিকে গমন। গ্রীষ্ম বছরের পয়লা ঋতু। প্রথমেই গ্রীষ্ম ঋতু বছরে গমন করে, তাই গ্রীষ্ম ঋতুকে গরমকাল কয়, গরমকালই গ্রীষ্ম ঋতু হয়।’ গ্রামের মানুষ ঋতু নামের উচ্চারণগত ধ্বনির সঙ্গে অপরাপর শব্দের ধ্বনিগত সাদৃশ্য মিলিয়ে এখানে গ্রীষ্ম শব্দটির যুক্তিনিষ্ঠ যে কটি অর্থ প্রদান করেছেন, তা একই সঙ্গে গ্রীষ্ম ঋতুর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের প্রকাশক। হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রণীত বাংলা শব্দের প্রামাণ্য অভিধান বঙ্গীয় শব্দকোষ-এ শব্দটির যে কটি অর্থ উত্থাপিত হয়েছে, তা মূলত একটাই অর্থ জ্ঞাপন করেছে। কিন্তু গ্রামীণ মানুষের ব্যাখ্যায় ‘গ্রীষ্ম’ শব্দটির বিচিত্র অর্থ ও অর্থান্তর প্রত্যক্ষ করা গেছে। অধ্যাপক মিলন দত্ত ও অধ্যাপক অমলেন্দু মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত শব্দসঞ্চয়িতাতে বলা হয়েছে—বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মিলে গ্রীষ্মকাল।
অধিকাংশ অভিধানে ‘বৈশাখ’ শব্দের পরিচয় দেওয়া হয়েছে বাংলা বছরের প্রথম মাস হিসেবে। কিন্তু বঙ্গীয় শব্দকোষ-এ বলা হয়েছে, ‘যে মাস বৈশাখী, অর্থাৎ বিশাখানক্ষত্রযুক্ত পৌর্ণমাসী; বৎসরের প্রথম মাস; মাধব।’ অথচ গ্রামীণ সাধারণ মানুষের ভাষ্য হলো, ‘বৈশাখ হচ্ছে—বয় শাখ, মানে শাখে কিছু বয়। শাখে মানে গাছের ডালে, ডালের ভাল নাম শাখা।’ তাঁরা বৈশাখ শব্দটির অর্থ সম্পর্কে আরও বিস্তৃত করে বলেন, ‘বৈশাখে গাছের শাখায় যেমন বাতাস বয় তেমনি বাতাসের সাথে রসও বয়। আসলে, বৈশাখে শাখায় শাখায় রস বয় বলেই তো “বৈশাখ” হয়—বৈশাখ মাসে গাছে গাছে ফলের কত না বাহার দেখা যায়—আর জ্যৈষ্ঠ মাসে বৈশাখের সেই রস বেড়ে ওঠে। একটুখানি চোখ মেলে দেখলেই বেশ বোঝা যায়—বৈশাখে ধরা ফলগুলো জ্যৈষ্ঠ মাসে পেকে ওঠে, পেকে রসালো হয়ে যায়।’ এ ধরনের কথার পিঠে তাঁরা আরও যুক্ত করেন, ‘জ্যেষ্ঠ থেকে জ্যৈষ্ঠ। যেমন বলা হয়—বয়োজ্যেষ্ঠ, মানে বয়সে বড়—আসলে, বৈশাখের রস বেড়ে উঠেই জ্যৈষ্ঠ হয়। আর এই বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মিলেই গ্রীষ্ম ঋতু হয়।’
বর্ষা
এরপর আসে বর্ষাকাল। বর্ষা শব্দটির নামবিচারে বঙ্গীয় শব্দকোষ-এ হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন—বর্ষা একটি স্ত্রীবাচক শব্দ, যার পুংলিঙ্গ বা ক্লীবলিঙ্গ হলো ‘বর্ষ’। তিনি দুইভাবে এই শব্দের অর্থ প্রদান করেছেন, ‘১ মেঘবারিপাত, বর্ষণ, বৃষ্টি’ এবং ‘২ বর্ষণ করা।’ অবশ্য দ্বিতীয় অর্থের পাশে তিনি একটি খনার বচন উদ্ধৃত করেছেন, যা এরূপ, ‘বিনা বাতাসে বর্ষে তুলা কোথা রাখবি ধান।’ তার ঠিক পরে বর্ষা শব্দটিকে স্ত্রীলিঙ্গের অধীন করে হরিচরণ লিখেছেন, ‘১ “বর্ষযুক্ত কাল”, ঋতুভেদ, প্রাবৃট্। ২ বর্ষণ, বৃষ্টি। ৩ বর্ষণ করা।’ উল্লেখ্য, সর্বশেষ অর্থটির পাশে একটি প্রবচন ও তার গৌণার্থ প্রদান করেছেন। যথা, ‘যত গর্জ্জায়, তত বর্ষায় না’, যার গৌণার্থ হলো, ‘মুখে যত কাজে তত নয়।’ কিন্তু গ্রামের মানুষের কাছে বর্ষা শব্দটির ধ্বনিগত তাৎপর্য অধিকতর গুরুত্ব পেয়েছে। একই সঙ্গে লড়াকু বাঙালির আত্মপরিচয়ের ধাতব অস্ত্রের কথাও প্রকাশ পায় ‘বর্ষা’ শব্দটির অর্থ প্রদানে। তাঁরা বলেন, ‘বর্ষা বানানে “শ” দিলে কিন্তু বর্শা হয়, যার মানে বল্লম, তারে আমরা সড়কিও কই। আবার বর্ষা, বর্ষ, বর্ষণ এই তিনটে কথা যদি বলি, তাহলে কি হয়? বর্ষাকালে কি হয়? বৃষ্টি যেন বর্শা/বল্লম/সড়কির মতো উপর হতে পড়তে থাকে এই বর্ষাকালে।’ অবশ্য হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বঙ্গীয় শব্দকোষ-এ বর্ষ, বর্ষা শব্দ দুটির পূর্বে বর্শা শব্দটি অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
আষাঢ় ও শ্রাবণ মিলে বর্ষা ঋতু। এই দুটি মাসের নামবিচার সম্পর্কে গ্রামের মানুষের বিবেচনা হচ্ছে, ‘অসাড় থেকে আষাঢ় হয়। বৈশাখের রস জ্যৈষ্ঠ মাস হয়ে আরো বেড়ে যখন একেবারে অসাড় হয়ে যায় তখন সে রস কি আর সহ্য হয়? হয় না। তাই বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসে জমে থাকা মেঘ ভেঙে বৃষ্টি নামে, গাছের পাকা টশটশে ফল ঝর ঝর করে ঝরে পড়ে, মানে একেবারে অসাড় হয়ে, অজ্ঞান হয়ে ঝরে পড়তে শুরু করে। তার পরও যারা কোনো না কোনোভাবে থেকে যায়, শ্রাবণে তাদের আর রক্ষা নাই, শ্রাবণে তারা নিশ্চিতই ঝরে পড়ে। শ্রাবণ শব্দটির সাথে কয়েকটি শব্দ মনে আসে, যেমন—শ্রাব, শ্রা-বন। শ্রাব মানে কি? এখানে শ্রাব মানে রস। আবার শ্রা-বন, বন মানে জঙ্গল, জঞ্জাল। আষাঢ়ে অসাড় রস শ্রাবণে জঞ্জাল হয়, অর্থাৎ রস তখন উথলে উথলে পড়ে।’ এ তো গেল গ্রামের মানুষের ভাষ্য। এবার দেখা যাক, এ দুটি মাস সম্পর্কে অভিধান প্রণেতাগণ কী লিখেছেন। হরিচরণ লিখেছেন, ‘আষাঢ়ী পৌর্ণ-মাসী যে মাসে’ তা-ই আষাঢ়। তিনি আরও লিখেছেন, ‘আষাঢ়ানক্ষত্রযুক্তা পৌর্ণমাসী’ হলো আষাঢ় মাস। একইভাবে তিনি শ্রাবণ সম্পর্কে লিখেছেন, ‘শ্রবণনক্ষত্রে জাত’ বা ‘শ্রবণনক্ষত্রযুক্তা পৌর্ণমাসী’ হলো শ্রাবণ মাস। এ ক্ষেত্রে উল্লেখ করা যেতে পারে, জ্যোতিষী গণনায় বা শাস্ত্রীয়ভাবে নক্ষত্রজাত মাস হিসেবে অভিধান প্রণেতাগণ যেখানে বাংলা মাস নামকে বিচার করেছেন, সেখানে গ্রামবাংলার মানুষ তাঁদের অভিজ্ঞতাজাত প্রকৃতিকে অবলম্বন করেই সাধারণত ঋতু-মাসের নামবিচার করেছেন।
শরৎ
এ পর্যায়ে বাংলার তৃতীয় ঋতুর প্রসঙ্গে আসি। গ্রামের মানুষ পূর্বে ঋতু আলোচনার ধারাবাহিকতায় বলেন, ‘সারা বছরে চাষ-বাসের রস যখন শ্রাবণ মাসে উথলে ওঠে তখন আসে শরৎ। শরৎ, শর, সর। কখনো আমরা কারো উপর বিরক্ত হলে বলি—তুই সর, সরে যা। মানে তোর জ্বালায় আর বাঁচিনে, তুই যা তো… সর তো। আসলে, আষাঢ়-শ্রাবণে জমে থাকা বর্ষা ঋতুর জল-রস যখন আর সহ্য হতো না তখন আগের দিনের মানুষ বলতো যে, “বর্ষা রে, ও-বর্ষা, তোর জ্বালায় যে আর বাঁচিনে, তুই এখন একটু সর তো।” এই “সর তো” বলতে বলতেই বর্ষার পরের ঋতুর নাম হয়ে গেল—শরৎ। শরৎ হচ্ছে দুধে সর পড়া ঋতু। মানে দুধের সরের মতো সুন্দর একটা ঋতু। শরতে দারুণ সুখ সুখ লাগে! চারদিকে কেমন যেন সবুজে ভরে যায়।’ এবার বঙ্গীয় শব্দকোষ-এ দৃষ্টিপাত করা যাক, এখানে শরৎ (-দ্) শব্দটির যে অর্থগুলো দেওয়া হয়েছে তা হলো, ‘১ সংবৎসর (সায়ণ), সমা, বৎসর। ২ ঋতুবিশেষ, মেঘান্ত।’ এরপর বিভিন্ন সাহিত্যকীর্তিতে কীভাবে ব্যবহূত হয়েছে, তার কয়েকটি উদাহরণ প্রযুক্ত হয়েছে। যেমন: রঘুবংশ-এ আছে ‘শরৎ পঙ্কজলক্ষণা’। ভট্টিকাব্য-এ আছে ‘বনস্পতীনাং সরসাং নদীনাম্… শ্রিয়ং দধানাং শরদং দদর্শ।’ গোবিন্দদাসের পদাবলীতে আছে, ‘চরণতল শীতল জীতল শরদরবিন্দ।’ ইত্যাদি। এখানেও রঘুবংশ ও ভাট্টিকাব্য-এ বর্ণিত ‘শরৎ পঙ্কজলক্ষণা’ ও ‘বনস্পতীনাং সরসাং নদীনাম… শ্রিয়ং দধানাং শরদং দদর্শ’-এর সঙ্গে গ্রামীণ মানুষের শরৎ ঋতুর পর্যবেক্ষণের ‘সবুজে ভরা’ প্রকৃতির সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে।
ভাদ্র ও আশ্বিন মাস মিলে শরৎ ঋতু। এই দুটি মাস সম্পর্কে গ্রামীণ মানুষের ভাষ্য হলো, ‘ভদ্র থেকে ভাদ্র, মানে ভাদ্র মাসে শ্রাবণ মাসের রসের বাহার ভদ্র হয়ে যায়, শান্ত হয়ে যায়। শ্রাবণের শ্রাব-রস পানির আকারে ভাদ্র মাসে এবার ধীরে-সুস্থে নামতে থাকে। এই জন্য এই সময়ে দেখা যায় পথ-ঘাট-ভাগাড়-মাঠ সবকিছু পাক-সাক হয়ে যায়, মনে হয় কে যেন তামাম দুনিয়া ধুয়েমুছে দিয়েছে। এরপর আশ্বিন আসে। আসীন থেকে আশ্বিন হয়েছে। আসীন মানে আসান গ্রহণ বা বসা। আসলে, আগেই বলা হয়েছে, শ্রাবণের শ্রাব-রস ধীরে-সুস্থে নামতে থাকে, সেই নামারও তো শেষ আছে, কিন্তু নামতে নামতে শেষকালে সেই রস যাবে কোথায়? যাবে আর কোথায়? বসে যায়। কখন বসে যায়? আশ্বিন মাসে।’ এই দুটি মাস সম্পর্কে বঙ্গীয় শব্দকোষ-এ বলা হয়েছে, ‘যাহাতে ভাদ্রী পৌর্ণমাসী আছে’ বা ‘ভাদ্রপদানক্ষত্রযুক্তা পৌর্ণমাসী’ হলো ভাদ্র। এটি ‘বৎসরের পঞ্চম মাস’ এবং ‘অশ্বিনীনক্ষত্রযুক্তা পৌর্ণমাসী’ হলো আশ্বিন মাস। পক্ষান্তরে গ্রামের মানুষের বিস্তৃত ব্যাখ্যা হচ্ছে, ‘আসলে, সেই বৈশাখের বয়ে যাওয়া রস জ্যৈষ্ঠে বেড়ে ওঠে, আষাঢ় মাসে অসাড় হয়ে, শ্রাবণে রস আকারে ঝরে যায় এবং আশ্বিনে এসে তা আসীন হয় বা বসে পড়ে প্রকৃতির শরীরে।’ শুধু তাই নয়, গ্রামের মানুষের আরও ভাষ্য হলো, ‘বাংলা ঋতুর রসের পর্ব এভাবেই আশ্বিনে এসে শেষ হয়। কার্তিকে নতুন পর্ব শুরু হয়।’
হেমন্ত
‘কর্তন হতে কার্তিক এসেছে। কর্তন মানে পৃথক করা, কাটা। এই কার্তিকই বাংলা বছরকে দুই ভাগ করে দেয়। আসলে, আশ্বিনে রসের পর্ব শেষ, আর কার্তিক সেই রস কেটে দিয়ে নি-রস তথা শুকনোর পর্ব শুরু করে। কার্তিক হলো হেমন্ত ঋতুর প্রথম মাস।’ এই কার্তিক সম্পর্কে বঙ্গীয় শব্দকোষ-এ বলা হয়েছে, ‘কৃত্তিকানক্ষত্রযুক্ত (কাল)’ আর হেমন্ত সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘হেমন্ত ১ পুং, ক্লী [হন্ + অন্ত] হিমঃ অন্ত যশ্য ইতি মনীষাদি। (ভারত); হিমবন্ত মূল।’ এবং ‘হেমন্ত ২ বি [হিমবন্ত > ০ন্ত (?)] হিমবান্ পর্ব্বত, হিমালয়।’ কিন্তু গ্রামীণ মানুষের সুবিস্তৃত বিচার হচ্ছে, ‘হিম + অন্ত = হেমন্ত। হিম মানে ঠাণ্ডা, অন্ত মানে শেষ। তাহলে পুরো হেমন্ত মানে ঠাণ্ডা-শেষ। কিন্তু হেমন্ত তো ঠাণ্ডার শুরু। আসলে, এখানে ওই-অন্ত না। এই অন্ত হচ্ছে আন্ত, মানে আন্-তো, আনো-তো, আনে-তো। একদিন এদেশের মানুষ দেখল যে—আরে, অবাক কাণ্ড তো—শরৎ চলে গেছে, আর সেই সুযোগে বাতাস ঠাণ্ডা বয়ে আনে তো, হিম আনে তো, তারা তখন বলতে লাগল যে,—ওগো, এই দেখো, বাতাস হিম আনে তো, হিম আনে তো, কেউ কেউ আবার সংক্ষেপে বলল যে, হেমন্ত এসে গেছে।’ আগেই বলা হয়েছে, হেমন্তের প্রথম মাস হলো কার্তিক। এই কার্তিক এসে একটা বছরকে দুই ভাগে কর্তন করে দেয়, মানে কেটে দেয়। আবার কার্তিক মাসেই মাঠে ধান-ফসল কাটার ধুম পড়ে যায়। অর্থাৎ, মাঠে ধান কেটে একটা বছর শেষ করা হয়। আর কার্তিকে কাটা সেই ধান দিয়ে অগ্রহায়ণ মাসে পিঠা বানিয়ে, পায়েস রেঁধে, নতুন চালের ভাত রেঁধে নতুন আরেকটা বছর শুরু করা হয়। গ্রামের মানুষের ভাষ্য অনুযায়ী, ‘অগ্র মানে সমানে, মানে প্রথম, আর হায়ণ মানে বছর।’ আসলে, অগ্র-হায়ণ দিয়েই এখনো কিন্তু এ দেশে নতুন বছরের শুরু হয়। শিক্ষিত ও নগরকেন্দ্রিক মানুষ না মানলেও গ্রামীণ মানুষের জীবনে এটাই সত্যি।
শীত
এরপর আসে শীত। বঙ্গীয় শব্দকোষ-এ আছে, ‘শীত বিণ [শীত + অ (অচ্); স্ত্রী -তা] ১ শীতস্পর্শ (সায়ণ), শীতল, শৈত্যযুক্ত, শিশির।’ শব্দটির প্রয়োগ উদাহরণ হিসেবে ঋগ্বেদ-এর একটি চরণ উদ্ধৃত হয়েছে, যথা, ‘(আঙ্গারাঃ) শীতাঃ সন্তো হূদয়ং নির্দহন্তি।’ এর সঙ্গে গ্রামীণ মানুষের ভাষ্য মিলিয়ে দেখা যেতে পারে। যেমন, ‘শীতল বাতাস লাগলে আমরা বলি যে, শীত এসেছে। গোসলের সময় শরীরে প্রথম যখন পানি লাগে তখন ঠাণ্ডায় শি-শি করতে করতে “শীত” বলে ফেলি। এভাবেই ঠাণ্ডার সময় শীতকাল হয়ে গেছে।’ পৌষ ও মাঘ মিলে শীতকাল। পোষা থেকে পোষ, আর পোষ থেকে পৌষ। ওই যে গানে আছে না, ‘পোষাপাখি উড়ে যাবে সজনী/একদিন ভাবি নাই মনে…।’ আরও কথায় আছে, ‘বনের পাখি পোষ মানে না।’ এই পৌষ কিন্তু পুষে রাখার মাস, অর্থাৎ এই পৌষ মাস ঠান্ডা পুষে রাখে আর এই দেশের চাষিরা এই মাসে নবান্নের ফসল ঘরে তুলে রাখে। মানে সারা বছরের জন্য পুষে রাখে। আর মাঘ মাস? সেটা এসেছে মগ্ন থেকে। অনেক সময় বলি, ‘“মা-গো”, মা-গো থেকে বলি “মাগ”, আর মাগ থেকে হয়ে গেল মাঘ। কথায় কয় না, “মাঘের শীতে বাঘ কাঁপে।” এই মাঘে বনের বাঘ কাঁপে কি-না তা আমাদের জানা না থাকলেও মাঘের শীতে মানুষ যে জড়োসড়ো হয়ে যায় এবং বলে ওঠে, “মাগো ম’লাম শীত।” পৌষের পোষা শীত মাঘে এসে মগ্ন হয়ে যায়। মগ্ন মানে ধ্যান, অমুকের সাথে তমুক পিরিতি মগ্ন হয়েছে, মানে প্রেমে পাগল হয়েছে, আত্মহারা হয়েছে, হুস-বোধ কিচ্ছু নাই, জাত-মান সব গেল দেখছি। এই হ’লো মগ্ন-ভাব। মাঘ এমন হুস-বোধ শূন্য মগ্ন শীতের মাস।’ এই দুটি মাস সম্পর্কে বঙ্গীয় শব্দকোষ-এ লেখা হয়েছে, ‘পোষ অর্থ “পালন”, “পোষণ”’ এবং মাঘ হলো ‘মঘানক্ষত্রযুক্ত’ বা ‘মাঘীপৌর্ণমাসীযুক্ত মাস’।
বসন্ত
বাংলা বছরের শেষ ঋতু বসন্ত। এ ঋতু সম্পর্কে গ্রামীণ মানুষের ভাষ্য হলো, ‘বস + অন্ত = বসন্ত। বস থেকে বসন, আবার বস থেকে বাস, বাস থেকে বাসনা। বছরের অন্ত হচ্ছে বসন্ত। সকল ঋতুর অন্তে বসে যে ঋতু সেই হচ্ছে বসন্ত। বসন মানে পোষাক বা বস্ত্র। বাস মানে সুবাস, গন্ধ। বাসনা মানে আশা, ইচ্ছা। আসল কথা হলো—বসন্তে প্রকৃতি তার এক বসন ছাড়ে আবার আরেক বসন পরে, গাছে গাছে তাই ফুল ধরে সুবাস ছড়ায়, সকলের মধ্যে বাসনা জেগে ওঠে। বছরের শ্যাষ, তার উপর আবার চারদিকে রঙের বাহার, এরই মধ্যে কামের বাসনা না-জেগে কি পারে!’ অন্যদিকে এই ঋতু সম্পর্কে বঙ্গীয় শব্দকোষ-এ বলা হয়েছে, ‘বসন্ত + পুং [বস্ + অন্ত] ১ “যাহাতে কামের বাস” (আ.টী); ষষ্ঠ ঋতু—চৈত্র ও বৈশাখ; (মতান্তরে) ফল্গুন ও চৈত্র। বিহরতি হরিরিহ সরসবসন্তে গী.গো ১.২৮। ২ কামসখ। “সুহূদঃ পশ্য বসন্ত কিং স্থিতম্ কু.স ৪.২৭। ০ঘোষ (পুং)—কোকিল। ০বন্ধু, ০সখ, ০সহায় (পুং)—কামদেব”।’ হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বঙ্গীয় শব্দকোষ-এ উদ্ধৃত অর্থগুলোর সঙ্গে তো বটেই, এমনকি চন্দ্রমোহন তর্করত্ন প্রণীত অমরকোষ-এর টীকা, জয়দেবের গীতগোবিন্দ ও কালিদাসের কুমারসম্ভব কাব্যের চরণগুলোর মূলভাবের সঙ্গে কোথায় যেন গ্রামীণ মানুষের বসন্তভাষ্যের অনেক সাদৃশ্য রয়ে গেছে। সে যা-ই হোক, বসন্তের অন্তর্ভুক্ত ফাল্গুন ও চৈত্র মাস দুটি সম্পর্কে এবার কিছু কথা বলা সমীচীন। বঙ্গীয় শব্দকোষ-এ বলা হয়েছে—ফাল্গুন হচ্ছে ‘ফাল্গুনীনক্ষত্রজাত’ মাস, আর চৈত্র হচ্ছে ‘চিত্রানক্ষত্রযুক্তপৌর্ণমাসী-বিশিষ্ট মাস; মধুমাস।’ কিন্তু গ্রামীণ মানুষের ভাষ্যে পাওয়া যাচ্ছে, ‘ফাল + গুণ = ফাল্গুন। ফল থেকে ফাল। এখানে ফাল মানে হলো টুকরো, ছোট। ফাল্গুনে গাছের পাতারা টুকরো টুকরো হয়ে ঝরে পড়ে, আবার গাছে গাছে কচি কচি পাতা জেগে ওঠে, আর গাছগুলো যেন আগাম ফলের জন্য দিন গুনতি গুনতি ফুল ফোটাতে থাকে। আর চৈত্র? আসলে, চরিত্র থেকে চৈত্র কথাটি এসেছে। বছরের চরিত্র বোঝা যায় চৈত্র মাসে। সারা বছরের বাছ-বিচার করা যায় চৈত্র দেখে।’
গ্রামীণ মানুষের কাছে ঋতু-মাসের নামবিচার অনেকটাই বঙ্গের জীবনসংশ্লিষ্ট প্রকৃতির অভিধান থেকে উৎসারিত, কিন্তু বাংলা ঋতু-মাসের নামবিচারে আজও গ্রামীণ মানুষের এই যুক্তিবাদী সত্যনিষ্ঠ ভাষ্যকে আমলে নেওয়া হয়নি।
[বিসর্গে প্রবন্ধটি পুনরায় প্রকাশিত]
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, এপ্রিল ২২, ২০১১