ইতিহাসবেত্তাদের মতে, সক্রেটিস হলেন পৃথিবীর প্রথম দার্শনিক ও চিন্তাবিদ যাকে তার চিন্তা, দর্শনের জন্য মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয়েছিল। অথচ প্রায় আড়াই হাজার পর মরণোত্তর বিচারে ঠিকই কিন্তু সক্রেটিস নির্দোষ প্রমাণিত হয়েছেন।
সক্রেটিসকে বলা হয় জ্ঞানের জনক। অথচ নিজেকে তিনি কখনও জ্ঞানী বলে মনে করতেন না। বরং প্রায়শ:ই বলতেন, ’আমি জ্ঞানী নই, জ্ঞানানুরাগী মাত্র। একটি জিনিসই আমি জানি; আর সেটা হচ্ছে এই যে, আমি কিছুই জানি না।’
পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে আলোচিত ও নন্দিত এই মুক্ত বুদ্ধিচর্চার দার্শনিক খ্রিস্টপূর্ব ৪৭০ সালে গ্রিসের এথেন্সে নগরীতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তিনি এমন এক দার্শনিক আদর্শ ও মূল্যবোধের প্রবর্তক যা কিনা পাশ্চাত্য সভ্যতা, সংস্কৃতি ও দর্শনকে দুই হাজার বছরেরও অধিক কাল ধরে প্রভাবিত করে রেখেছে।
এই মহান দার্শনিকের সম্পর্কে তথ্য লিখিতভাবে পাওয়া গেছে কেবল মাত্র তার শিষ্য প্লেটোর ডায়ালগ এবং সৈনিক জেনোফন এর রচনা থেকে।
সক্রেটিসের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ সমূহ
জ্ঞান, শিক্ষা ও দর্শন দিয়ে তিনি এথেন্সের মানুষের হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছিলেন। ফলে তাঁর অনুসারীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছিল। কিন্তু দেশটির শাসক গোষ্ঠী এ জনপ্রিয়তা মেনে নেয়নি। পছন্দ করেনি তাঁর শিক্ষা, দর্শন, স্পষ্টবাদিতা ও খ্যাতি। এছাড়াও সক্রেটিসকে তরুণ সম্প্রদায়ের মধ্যে চরিত্রহীনতা ও দুর্নীতি প্রবেশ করানোর অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়।
বিদ্বেষীরা সক্রেটিসের বিরুদ্ধে ৩টি প্রধান অভিযোগ এনেছিল-
১. দেশের প্রচলিত দেবতাদের প্রতি উপেক্ষা প্রদর্শন
২. নতুন নতুন দেবতার প্রবর্তন করার চেষ্টা, এবং
৩. যুবকদের নৈতিক চরিত্র কলুষিত করে তাদের বিপথগামী করা।
মূলত: মেনেতুস, লাইকন, আনাতুস নামের তিনজন বিশিষ্ট নাগরিক সক্রেটিসের বিরুদ্ধে অভিযোগগুলো এনেছিল। তাদের মধ্যে প্রথম জন ছিল মধ্যম শ্রেণীর কবি, দ্বিতীয় জন ছিল বক্তা এবং তৃতীয় জন ছিল গণতান্ত্রিক নেতা। উপরিউক্ত অভিযোগে তাঁকে কারাগারে প্রেরণ করা হয়। তারপর শুরু হয় প্রহসনের বিচার। বিচারের উদ্দেশ্যে এথেন্সে আলোচোনের সভাপতিত্বে ৫০০ সদস্যের বিচাকের প্যানেল গঠন করা হয়। ঐ সময়কার বিচারসভায় কোন উকিল বা আইনজীবী থাকতো না। অভিযোগকারী এবং অভিযুক্ত উভয়কেই নিজের পক্ষ সমর্থন করে যুক্ত-তর্ক উপস্থাপন করতে হতো। বিচারসভায় প্রথমে ঐ তিন অভিযোগকারী তাদের অভিযোগ বর্ননা করে। তারপর সক্রেটিস উঠে দাঁড়িয়ে নিজের বক্তব্য পেশ করেন। সেদিন বিচারকমণ্ডলীর সামনে সক্রেটিস এক দীর্ঘ বক্তৃতা দিয়েছিলেন। ’সক্রেটিসের জবানবন্দি’ নামক সে বক্তব্য সহ পুরো ঘটনা পরবর্তিতে তাঁর শিষ্য প্লেটো লিখে গেছেন। চমৎকার সে রচনা আজো বিশ্ব সাহিত্যের এক অমূল্য সম্পদ।
প্রহসনের রায় ও শাস্তি
প্রহসনের রায়ে ৬০ ভোটের ব্যবধানে সক্রেটিস অপরাধী হিসাবে বিবেচিত হন। তবে প্রথমেই তাঁর শাস্তি মৃত্যুদণ্ড হয়নি। বিচারের শেষ মুহূর্তে শাস্তি এড়াতে না পারলেও মৃত্যুদণ্ড এড়াতে পারতেন সক্রেটিস। তখন এথেন্সের বিচার ব্যবস্থায় অপরাধ চিহ্নিত হবার পর অপরাধীকে জিজ্ঞেস করা হতো, সে কী শাস্তি চায়। পাঁচশ’ জুরির উপস্থিতিতে সক্রেটিসকেও জিজ্ঞেস করা হয়, তিনি কী শাস্তি চান। কিন্তু যেহেতু সক্রেটিস নিজেকে অপরাধী মনে করতেন না তাই বিষয়টা তিনি পাত্তা দিলেন না। তাঁর আচরণ ছিলো স্বভাবসুলভ অনমনীয়। তিনি শাস্তির পরিবর্তে পুরস্কারের প্রস্তাব করেন! নির্বিকার সক্রেটিস প্রস্তাব করলেন যেন প্রাইটেনিয়াম হলে (পাবলিক হল) যেন তাঁর উদ্দেশ্যে বিশেষ ভোজের আয়োজন করা হয়, প্রথাগতভাবে যা করা হতো গ্রীসের বীরদের জন্য। এতে বিচারকরা আরো ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠেন। তাঁরা ধরে নেন, সক্রেটিস এই বিচারকে প্রহসন মনে করছে এবং তাঁদের অসম্মান করছে। ফলে রায় হয়, মৃত্যুদণ্ড। প্রথমে তাঁর বিরুদ্ধে জুরি ছিলেন ২৮০ জন এবং স্বপক্ষে ছিলেন ২২০ জন। তাঁর ঐ উত্তর শুনে বিরুদ্ধে হয়ে গেলো ৩৩০ জন।
বিচারের প্রায় একমাস পর হেমলক বিষ পানে সক্রেটিসের মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়েছিল। এই এক মাস সময় তিনি কারাগারে বন্দি ছিলেন। এ সময়টায় অবশ্য সক্রেটিসের শিষ্য, বন্ধু এবং পরিবারের সদস্যরা নিয়মিত জেলে আসতে পারতো এবং থাকতে পারতো। তবে প্রহরীরা তখন ছায়ার মতো থাকতো। আর মৃত্যুদন্ডের আগে পালাবার সুযোগও পেয়েছিলেন সক্রেটিস। কিন্তু এথেন্স ছেড়ে কোথাও যাননি তিনি। হেমলক বিষপান করে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ মাথা পেতে নিয়েছিলেন সক্রেটিস। সক্রেটিসের মৃত্যুর সালটি ছিল খ্রিস্টপূর্ব ৩৯৯ ।
সক্রেটিসের মৃত্যুর পরেই এথেন্সের মানুষ ক্ষোভে দুঃখে ফেটে পড়ে। ধিক্কার উঠে চারিদিক। বিচারকদের দল সর্বত্র একঘরে হয়ে পড়ে। অনেকে অনুশোচনায় আত্মহত্যা করেছিল। অভিযোগকারীদের মধ্যে মেনেতুসকে পিটিয়ে মারা হয়েছিল, অন্যদের দেশ থেকে বিতাড়িত করা হয়। পরে এথেন্সবাসী সক্রেটিসের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে তাঁর বিরাট এক মূর্তি তৈরি করেছিল।
২৪১৫ বছর পর পুনরায় বিচারে নির্দোষ প্রমাণিত হলেন সক্রেটিস
কিন্তু সত্যিই কি সক্রেটিস দোষী ছিলেন? ২০১২ সালে সেই জবাব জানার জন্য এথেন্সের ওনাসিস ফাউন্ডেশনের একটি আদালতে পুনরায় নতুন করে বিচারব্যবস্থার আয়োজন করে। সেই আদালত গ্রিক দার্শনিক সক্রেটিসকে সম্পূর্ণ নির্দোষ বলে রায় দেয়। তাঁর মৃত্যুদণ্ড প্রদানের দুই হাজার চারশত পনের বছর পর এ রায় দেয় এথেন্সের আদালত। আর এর মধ্য দিয়ে সুদীর্ঘ ২৪১৫ বছর পর বিশ্ববাসীর কাছে প্রমাণিত হয় যে দার্শনিক সক্রেটিস ছিলেন নিরপরাধ ও নির্দোষ। তিনি তরুণদের বিভ্রান্ত করেননি। ধর্মবিশ্বাসের অপব্যাখ্যাও তিনি করেননি। চৌর্যবৃত্তির প্রশ্রয়দাতাও সক্রেটিস ছিলেন না। তাঁর বিরুদ্ধে সব অভিযোগ ছিল প্রহসনের-মিথ্যে এবং সাজানো।
আদালতে সক্রেটিসের সমর্থনে তাঁর আইনজীবী বলেছিলেন, ‘কোনো ব্যক্তির অভিমত অপরাধ হতে পারে না। সক্রেটিস সত্যের সন্ধান করতেন। আর তা করতে গিয়েই তিনি তাঁর আপন মত তুলে ধরতেন। তবে সক্রেটিসের অবশ্য একটা দোষ ছিল, আর তা হলো, তিনি উস্কানিমূলক কথা বলে মানুষকে ক্ষেপিয়ে তুলতেন। সবসময় বাঁকা বাঁকা কথা বলতেন। যেমন- তিনি বলতেন, দেখাও তোমাদের গণতন্ত্র কতটুকু খাঁটি ও বিশ্বাসযোগ্য ইত্যাদি।’ এই আদালতে আইনজীবী আরও বলেন যে, ’সাধারণ কোন মামলাকে জটিল করবার জন্য মৃত্যুদণ্ডের মতো শাস্তি দেয়াটা কোনো ভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়।’
সক্রেটিসের হয়ে এই মামলায় ফ্রান্সের বিখ্যাত আইনজীবী সওয়াল করেন। উল্টোদিকে গ্রিসসহ বেশ কয়েকটি দেশের আইনজীবীরা ছিলেন সক্রেটিসের বিরোধী পক্ষে। এই মামলার বিচারের জন্য আমেরিকা ও ইউরোপীয় বিচারকদের সমন্বয়ে একটি প্যানেল তৈরি করা হয়েছিল। দীর্ঘ বাগ-বিতন্ডতার পর সক্রেটিসের আইনজীবীর যুক্তিই মেনে নেন আদালত। রায় হয় সক্রেটিসের পক্ষে। পরে ২০১৬ সালে নিউইয়র্কের একটি আদালতেও সক্রেটিস নির্দোষ প্রমাণিত হয়েছিলেন।
প্রহসনের বিচারে মৃত্যুদন্ডের প্রায় আড়াই হাজার পর মরণোত্তর বিচারে সক্রেটিস অবশেষে নির্দোষ প্রমাণিত হন। এর মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হলো যে মানুষের আদালতে বিচার ভুল হতেই পারে। এমনকি বিচার যারা করেন তাঁরাও নানান প্রতিকূলতার কারণে ও প্রভাবিত হয়ে ভুল সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। সেদিন যদি হেমলক পানে সক্রেটিসকে হত্যা করা না হতো তাহলে পৃথিবী হয়তো সমৃদ্ধ হতে পারতো আরো অনেক দার্শনিক তত্ত্ব ও অমিয় বাণীতে। তবে তাঁর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে নশ্বর দেহের শেষ হলেও কিন্তু চিন্তার শেষ আজও হয়নি। যার প্রভাব আজো তাঁর প্রিয় শিষ্য প্লেটো এবং প্লেটো শিষ্য অ্যারিস্টটলের মধ্য দিয়ে অদ্যবধি বিরাজমান।
Featured Images Artist: Jacques-Louis David