ধর্ম ও মিথ

ধর্ম ও মিথ কী এক? তাদের মধ্যে সম্পর্কইবা কী

জানা অজানা মিথলজি

ধর্ম ও মিথের মধ্যে সম্পর্ক

ধর্ম ও মিথ মানব সভ্যতার এব অবিচ্ছেদ্য অংশ। পৃথিবীতে যেমন অসংখ্য ধর্ম রয়েছে তেমনি প্রচলিত আছে অসংখ্য মিথ। এ দু’টোর সম্পর্ক নিয়েই এই প্রবন্ধ।

সমাজে ধর্মের প্রবর্তন কবে থেকে শুরু তার সঠিক ধারণা কেউ দিতে পারে না। আর ধর্মের সাথে মিথের একটা গভীর সম্পর্ক সেই প্রাচীনকাল থেকেই বিদ্যমান। ধর্ম থাকলে মিথ থাকবেই। হোক সেটা ঐশ্বরিক ধর্ম কিংবা মানবরচিত ধর্ম। ধর্মপালনই মানুষের পৃথিবীতে মিথের জন্ম দেয়। এমনকি পৃথিবীর এমন কিছু ধর্ম আছে যেগুলো কেবল মিথের ওপর ভর করে প্রতিষ্ঠিত। মিথ দিয়ে সেসব ধর্মের আচরিক সকল যজ্ঞ অনুষ্ঠিত হয়।
মানব সভ্যতার ইতিহাস বলে, সমাজের বিস্তার ও বিবর্তন বৃদ্ধির সাথে সাথে মানুষও বিভক্ত হতে থাকে গোষ্ঠীতে গোষ্ঠীতে, মতবাদ আর সম্প্রদায়ে। আর মানুষ যখন ধর্মের মাঝে বিভিন্ন মতবাদ নিয়ে এল তখন ধর্মের মাঝেও বিভিন্ন শ্রেণিবাদ-মতবাদ দেখা দিল। এবং এই সব মতবাদের মধ্যে মানুষ আমদানি করল বিভিন্ন কেচ্ছা-কাহিনী, ভূত-প্রেত, দত্যি-দানব, ম্যাজিক, অলৌকিক বিশ্বাস, মোজেজা, ঈশ্বর্য প্রদর্শনের জাদুবিদ্যা, অদৃশ্য শক্তির কেরামতির সাহায্য নিয়ে মানুষকে মোহিত করার পন্থা। আর এর থেকেই সৃষ্টি হল মিথ, উপকথা, কেচ্ছা-কাহিনী, কিংবদন্তি। পৃথিবীতে এমন কোন ধর্ম খুঁজে পাওয়া যাবে না যার মধ্যে কোন না কোন মিথের প্রচলন নেই। আসলে মিথের মধ্যে গোপনে বা প্রত্যক্ষভাবে ধর্মীয় বোধের গভীরতা ও ধর্মীয় অচারের উপাদান মিশে থাকে। তাই বলা যায়, মিথ হচ্ছে সমাজের বাস্তবিক ব্যবস্থার উপজাত কাল্পনিক জগৎ।

 

“পৃথিবীতে অসংখ্য মিথ প্রচলিত। কোনোটা কিছু সত্য, কোনোটা আংশিক আর কোনোটা সর্বৈব বানোয়াট কল্পকাহিনি। কিন্তু তারপরও এসব মিথ মানুষ বিশ্বাস করে। শুধু বিশ্বাস করে তাই নয়, এসব মিথ দিয়েই তারা ধর্মের বিশ্বাসকে পরিপুষ্ট করে। ধর্মের জন্য এটা দুঃখজনক ব্যাপার। ধর্ম কখনো মিথ্যা কল্পকাহিনীর বাতাবরণের ওপর ভর করে প্রতিষ্ঠা লাভ করতে পারে না। অথচ অনেক ধর্মীয় কল্পকাহিনীই ধর্মের জায়গা দখল করে নিয়েছে। সৃষ্টি হয়েছে প্রবল প্রতাপশালী মিথ।”

 

যদিও ধারণা ও বৈশিষ্ট্যের দিক দিয়ে ধর্ম (Religion) ও মিথ (Myth) এবং  আলাদা, তারপরও তারা গভীরভাবে সম্পর্কিত। যেমন: হিন্দু ধর্মে রামায়ণ ও মহাভারত হিন্দু মিথলজি, কিন্তু একই সাথে হিন্দু ধর্মের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তেমনি খ্রিস্টান ধর্মে বাইবেলের কিছু কাহিনীকে অনেক সময় মিথ হিসেবেও দেখা হয়। যেমন- আদম-ইভের সৃষ্টি বা নোয়ার মহাপ্লাবন। খ্রিস্টান ধর্মের এইসব মিথের অনেক মিল ইসলাম ধর্মেও খুঁজে পাওয়া যায়। বিশেষ করে নোয়ার মহাপ্লাবনের কাহিনীর সাথে, গ্রীক পুরানের ডিউকিলিয়ন প্লাবন, মুসলমানদের পবিত্র কোরআন-এ বর্ণিত হযরত নূহ (আ:) এর মহাপ্লাবন এবং মেসোআমেরিকার মায়া সভ্যতার লোরে অব কিচের কাহিনীর দারুন মিল লক্ষনীয়। এগুলি মিথের আকারে শুরু হলেও আজ ধর্মীয় বিশ্বাসের অংশ হয়ে গেছে।
মিথ এবং ধর্মের মধ্যে সম্পর্ক বিশ্লেষণ করলে তাদের মধ্যে একাধিক স্তরে মিল ও পারস্পরিক সংযোগ পাওয়া যায়। চলুন গভীরভাবে এ দু’টির মধ্যে সম্পর্ক আরো আলোকপাত করা যাক:

 

উৎপত্তি ও বিকাশের মূল উৎস

ধর্ম ও মিথ উভয়ই মানব সভ্যতার আদি যুগ থেকে বিকশিত হয়ে আসছে। অনেক মিথ প্রাচীন ধর্মের উপাদান হিসেবে কাজ করেছে। সমাজের আধ্যাত্মিক ও নৈতিক মূল্যবোধ গড়ে ওঠতে সাহায্য করেছে। প্রাচীন সমাজে মিথগুলোই ছিল ধর্মের ভিত্তি, যা পরবর্তীতে ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান ও বিশ্বাসে রূপান্তরিত হয়। উদাহরণস্বরূপ, গ্রিক মিথলজির দেবদেবীর গল্পগুলি প্রাচীন গ্রিক ধর্মের অংশ ছিল।

ধর্মের ভিত্তি হিসেবে মিথ

বিভিন্ন ধর্মে মিথ ব্যবহার করা হয় ধর্মীয় বিশ্বাস ও আচার-অনুষ্ঠানকে ব্যাখ্যা করার জন্য। ধর্মীয় গ্রন্থে অনেক সময় মিথের রূপকথা ও গল্পগুলিকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। হিন্দু ধর্মের মহাভারত ও রামায়ণ যেমন মিথলজির অন্তর্গত, তেমনি এই কাহিনীগুলি ধর্মীয়ভাবে অনুসৃত এবং উপাসনার অংশ হিসেবে বিবেচিত হয়।

বিশ্বাস ও রূপকতা

মিথ এবং ধর্ম উভয়ই মানুষের জীবনের মৌলিক প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করে- জীবনের অর্থ, সৃষ্টির কারণ, মৃত্যুর পরে কী ঘটে, ইত্যাদি। ধর্ম এগুলিকে আধ্যাত্মিক বিশ্বাসের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করে, যেখানে মিথ এসব প্রশ্নের উত্তর রূপক গল্পের মাধ্যমে দেয়। অনেক ধর্মীয় বিশ্বাস মিথের মতোই আধ্যাত্মিক কাহিনীতে জড়িত থাকে।

ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানে মিথের প্রভাব

ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান এবং উৎসবগুলো প্রায়শই মিথের ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে। উদাহরণস্বরূপ, হিন্দু ধর্মের দুর্গাপূজা বা রামলীলায় দেব-দেবীর কাহিনীগুলোকে অনুসরণ করা হয়, যা মূলত মিথলজির অংশ।

সমাজে মিথ ও ধর্মের ভূমিকা

মিথ ও ধর্ম উভয়ই সমাজের নৈতিক ও সাংস্কৃৃতিক কাঠামো গঠন করতে সাহায্য করে। ধর্ম প্রায়শই সামাজিক নিয়ম-কানুন ও মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা করে, যেখানে মিথ সমাজের প্রাচীন কাহিনী ও বিশ্বাসকে সুরক্ষা দেয়। দু’টিই মানুষের জীবনধারা ও সংস্কৃতির ভিত্তি হিসেবে কাজ করে।

বিশ্বদর্শন ও অস্তিত্ব

মিথলজি ধর্মের মাধ্যমে মানুষের অস্তিত্ব, সৃষ্টির প্রক্রিয়া, এবং অতিপ্রাকৃত শক্তির প্রতি বিশ্বাস গঠনে ভূমিকা পালন করে। ধর্ম প্রায়শই এই মিথগুলির মধ্য দিয়ে বিশ্বব্যাপী অস্তিত্ব এবং আধ্যাত্মিকতার প্রশ্নগুলোকে সমাধান করতে চায়।

রূপান্তর ও বিকাশ

যখন কোনো মিথ একটি সামাজিক বা ধর্মীয় প্রেক্ষাপটে বিশেষভাবে গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে, তখন তা ধর্মের অংশে পরিণত হয়। উদাহরণস্বরূপ, প্রাচীন মিশরের দেবতা হোরাস সম্পর্কে মিথ পরবর্তীতে মিশরীয় ধর্মের মূল বিশ্বাসে রূপান্তরিত হয়েছিল।
তাই ধর্ম ও মিথের মধ্যে একটি ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে, যেখানে মিথ প্রায়শই ধর্মের ভিত্তি হিসেবে কাজ করে। ধর্ম তার আধ্যাত্মিক ও নৈতিক মূল্যবোধকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য মিথের গল্পগুলোকে ব্যবহার করে এবং মিথ সময়ের সাথে সাথে ধর্মীয় বিশ্বাসে রূপান্তরিত হতে পারে।

Sharing is caring!

Shajahan Manik

ইংরেজি প্রভাষক শাহ্জাহান মানিক একাধারে কবি, লেখক, গবেষক ও অনুবাদক। একাধিক কাব্যগ্রন্থ ছাড়াও তার অনুদিত বইয়ের সংখ্যা ১০টি। এছাড়া সায়েন্স ফিকশন, সম্পাদনা, ছোটদের বইয়ের পাশাপাশি তার রয়েছে ইংরেজি শেখার বই। তার সর্বশেষ প্রকাশিত গ্রন্থ হচ্ছে- মানব কল্যাণে মুসলিম বিজ্ঞানীদের অবদান।

https://besorgo.com

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *