ক্রীতদাসের হাসি উপন্যাসটি শওকত ওসমানের একটি কালজয়ী সৃষ্টি। স্রোতের প্রতিকূলে গিয়ে প্রতিবাদী কলম ধরেছিলেন কথাসাহিত্যিক শওকত ওসমান। এই প্রবন্ধে ’ ক্রীতদাসের হাসি ‘ উপন্যাসটি নিয়ে আলোচনা করা চেষ্টা করা হয়েছে।
চরম দুঃখের সময় কাউকে যদি বলা হয় ‘এবার একটু হাসো তো’, তাহলে দুঃখীজন হাসতে পারে কি? কিন্তু এমনও দাম্ভিক স্বেচ্ছাচারী আছে যারা মনে করে আমিই যখন তার ভাগ্য বিধাতা তখন আমার ইচ্ছাতেই সে হাসবে আমার ইচ্ছাতেই কাঁদবে। এরকম মানসিকতা তৈরি হয়- যখন হাতে প্রচুর ক্ষমতা চলে আসে। আর ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য নানান ফন্দি ফিকির করে। কেউ এরকম পরিস্থিতির প্রতি বিরূপ মনোভাব পোষণ করলে তাকে দেয় কঠোর শাস্তি। শাস্তির ভয়ে তখন কেউ প্রকাশ্যে মুখ না খোললেও বিভিন্ন উপায়ে প্রতিবাদ চালিয়ে যায়।
এরকম একটা পরিস্থিতি চলছিল পূর্বপাকিস্তানে স্বৈরাচারী শাসক আইয়ুব খানের আমলে। স্রোতের প্রতিকূলে গিয়ে প্রতিবাদী কলম ধরেছিলেন কথাসাহিত্যিক শওকত ওসমান। লিখেছিলেন তাঁর শ্রেষ্ঠ উপন্যাস ‘ক্রীতদাসের হাসি’। আশ্রয় নিয়েছিলেন প্রতীকধর্মিতার। বুঝতে পারেনি বাঙালির কলমের প্যাঁচ। ফলে যার বিরুদ্ধে কলম ধরেছিলেন তারই হাত থেকে জিতে নেন শ্রেষ্ঠ উপন্যাস রচনার পুরস্কার।
অন্যায্যতার বিরুদ্ধে প্রতীকী প্রতিবাদের ভাষা সম্পর্কে আলোকপাত করার প্রয়াসে দেখে নেই তৎকালীন স্বৈরশাসক আইয়ুব খানের শাসনামল।
আইয়ুব খানের শাসনামল
মীরজাফরের চতুর্থ অধস্তন বংশধর তৎকালীন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মির্জার একান্ত বিশ্বস্ত সহচর ছিলেন আইয়ুব খান। ১৯৫৮ সালের ৭ জুন রাত ৮ টায় প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মির্জা পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র বাতিল করে দেশে সামরিক আইন জারি করেন। আইয়ুব খানকে প্রধান সামরিক আইন পরিচালকের দায়িত্ব দেন। দায়িত্ব পেয়ে আইয়ুব খান বিশেষ ক্ষমতার অধিকারী হলেন। ফলে তিনি হয়ে উঠলেন স্বেচ্ছাচারী। নিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার করেন বহু রাজনৈতিক নেতাকর্মীকে। ১০ অক্টোবর মওলানা ভাসানি ও শেখ মুজিবুর রহমান (পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধু ও জাতির জনক) কেও গ্রেফতার করেন।
আইয়ুব খান যার একান্ত অনুগত ছিলেন সেই প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মির্জাকে ক্ষমতা থেকে অপসারণ করে তিনি নিজেই প্রেসিডেন্টের পদ দখল করেন। দিনটি ছিল ২৭ অক্টোবর ১৯৫৮। সামরিক বাহিনীর প্রধান আইন পরিচালক হওয়ার মাত্র চার মাসের মাথায় তিনি প্রেসিডেন্ট হয়ে যান।
জবরদস্তি করে প্রেসিডেন্ট হয়েছেন, জনগণ সেটা ভালো চোখে দেখেনি। তাই তড়িঘড়ি করে জনগণের মন জয় করার জন্য কিছু পদক্ষেপ নিলেন।
১) ব্যবসায়ীদেরকে ভয়টয় দেখিয়ে জিনিসপত্রের দাম কমিয়ে দিলেন।
২) দুর্নীতি দমনের নামে মারপিট করে গ্রেফতার করা শুরু করলেন।
৩) দেশে শান্তি শৃঙ্খলা ফিরিয়ে এনে আবার সেনাবাহিনীতে ফিরে যাবার ঘোষণা দিলেন।
প্রথমদিকে জনগণ এটা বিশ্বাস করায় তিনি কিছু জনপ্রিয়তা লাভ করেন। মানুষকে সুখস্বপ্নে ব্যস্ত রাখার জন্য উন্নয়নমূলক কাজেও হাত দেন। পাশাপাশি ক্ষমতায় থাকার জন্য নানা পন্থা উদ্ভাবন করেন। Public Office Disqualification Order (PODO) এবং Elective Bodies Disqualification Order (EBDO) নামে দুটি আদেশ জারি করে দেশের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য অযোগ্য ঘোষণা করেন। ‘মৌলিক গণতন্ত্র’ নামে একটি প্রহসনমূলক আদেশ জারি করেন।
জনগণ অবশেষে টের পেয়ে যায় আইয়ুব খানের বদর্থক কূটকৌশল। রাজনৈতিক, আর্থিক, সামরিক ইত্যাদি বহুক্ষেত্রে বৈষম্য দেখা দেয়। এইসময় তার শাসনের প্রতি অনাস্থা প্রকাশের জন্য জনগণ সংগঠিত হতে থাকে এবং ধারাবাহিকভাবে পূর্ববাংলায় ১৯৬২ সালে ছাত্র আন্দোলন ও শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৬ সালে ছয়দফা আন্দোলন, ১৯৬৮ সালে ১১ দফা আন্দোলন এবং ১৯৬৯ সালে গণঅভ্যুত্থান সংঘটিত হয়।
আন্দোলনের মুখে নতি স্বীকার করে ১৯৬৯ সালের ২৫ মার্চ আরেক সামরিক শাসক ইয়াহিয়ার নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর করে পদত্যাগ করেন। পতন হয় স্বৈরশাসক আইয়ুব খানের।
১৯৬১-৬২ সালে যখন আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে ছাত্র আন্দোলনের প্রস্তুতি চলে, জনমনে স্বৈরাচারী সরকারের স্বরূপ ফুটে উঠে, তখনও প্রকাশ্যে প্রতিবাদ-রাজনীতির পরিবেশ ছিল না। এরকম একটা ভীত সন্ত্রস্ত অবস্থায় শওকত ওসমান কর্তৃক রচিত ‘ক্রীতদাসের হাসি’ উপন্যাসটি প্রকাশিত হয়।
উপন্যাসের বাগদাদ নগরী, খলিফা হারুনর রশীদ, হাবসি গোলাম তাতারি এবং হাসি প্রভৃতি চরিত্র ও অনুষঙ্গের মাধ্যমে অতীতের কাহিনি বর্ণিত হলেও প্রকৃত অর্থে ঔপন্যাসিকের মানস চেতনায় কাজ করছিল তৎকালীন পূর্বপাকিস্তান, আইয়ুব খান, পরাধীন বৈষম্যপীড়িত নির্যাতিত মানুষ এবং স্বাধীনতার স্বপ্ন। তাই ‘ক্রীতদাসের হাসি’তে পরাধীন বাংলাদেশির চিত্র প্রতীকায়িত হয়েছে লেখকের নবতর নিরীক্ষায়।
এই উপন্যাসে ঐতিহাসিক রাজনৈতিক ব্যঞ্জনা থাকলেও মানব জীবনের গূঢ়তর রহস্যও উন্মোচিত হয়েছে। সুখ দুঃখ মিলেই মানুষের জীবন। কিন্তু সেটা স্বাভাবিক পরিবেশে একরকম আবার কৃত্রিমভাবে সৃষ্ট পরিবেশে অন্যরকম। সবাই সুখের প্রত্যাশা করে। হারুনর রশীদও সুখ পেতে চেয়েছিলেন, হাসতে চেয়েছিলেন; কিন্তু তার আভিজাত্যের অহংকার, ক্ষমতার দম্ভ এবং অন্যের স্বাধীনতায় অযাচিত হস্তক্ষেপের কারণে, তথা ভ্রান্ত নীতির কারণে তিনি সে সুখ পাননি।
তিনি নিজে যখন নির্দোষ বোন ও ভগ্নিপতিকে হত্যা করে বিবেকের দংশনে নিজে নিজেই জ্বলে পুড়ে অঙ্গার হচ্ছেন তখন শুনলেন ক্রীতদাস তাতারির প্রাণখোলা হাসি। এমন হাসি তিনি নিজেও হাসতে চান, কিন্তু পারছেন না। তাই তাতারির হাসি কিনতে চেয়েছিলেন। তাতারি কোন সুখে এমন দিলখোলা হাসি দিতে পারে তার সত্যানুসন্ধান না করে ক্ষমতাবলে মেহেরজান ও তাতারিকে বিচ্ছিন্ন করে অর্থের বিনিময়ে হাসি কিনতে গেলেন। আইয়ুব খানও ভেবেছিলেন পূর্ববাংলার মানুষের মৌলিক অধিকার কেড়ে নিয়ে উন্নয়নের কথা বলে বাঙালিকে দমন করবেন।
উপন্যাসে তাতারিকে কারাগারে নিক্ষেপ ও নির্যাতন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিবাদী নেতাকর্মীকে কারাগারে নিক্ষেপ ও নির্যাতনেরই নামান্তর।
রাজাদেশ কিংবা অর্থের বিনিময়ে হারামকে হালাল ও হালালকে হারামের ফতোয়া আদায়ে হারুনর রশীদ এবং আইয়ুব খান সমার্থক। এক্ষেত্রে সেকাল ও একালের চাকুরিজীবী সুবিধাবাদী আলেম বা সমাজপতিদের চরিত্রের একটা দিক ফুটে উঠেছে।
কবি আবু নওয়াস খলিফার প্রহসনমূলক বিচার দেখে প্রতিবাদ করে বলেন, ‘এই বিচার ভুল, আলম্পনা’। তখন খলিফা ক্ষিপ্ত হন। খলিফার রোষানলে পড়ে তাঁর গর্দান যেতে বসেছিল। ঐ সময় কবি আবু নওয়াস বলেন, ‘আমার জন্মভূমি বাগদাদ। ভবিষ্যতের একটি মানুষ অন্তত বলবে, বাগদাদ অবিচারের কাছে মাথা নোয়ায়নি।’ এই সংলাপ পড়ে আইয়ুব খানের স্বেচ্ছাচারিতা ও পূর্ববাংলার কবি সাহিত্যিক, তথা বুদ্ধিজীবীদের ইতিবাচক তেজোময় ভূমিকা স্মরণীয় হয়ে উঠে।
শওকত ওসমান কবি আবু নওয়াসের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে তৎকালীন শাসন ব্যবস্থার ভুলগুলি চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেন। আর পরাধীন দেশে ক্রীতদাসের মতো জীবন যাপন থেকে বেরিয়ে এসে স্বপ্নের স্বাধীন বাংলায় প্রাণখোলা হাসি দিতে ‘ক্রীতদাসের হাসি’ মুক্তিকামী বাঙালিকে প্রেরণা যুগিয়েছিল। অতীতের ইতিহাস ও আলোচ্য উপন্যাস পর্যালোচনা করে দেখা যায়, একরোখা, পক্ষপাতদুষ্ট বা বৈষম্যনীতি, স্বৈরতান্ত্রিকতা ও আত্মকেন্দ্রিক মানসিকতা মানব সমাজে সার্বিক কল্যাণ বয়ে আনতে পারে না। তাই ‘ক্রীতদাসের হাসি’ হয়ে উঠে প্রতীকী ভাষায় অন্যায্যতার বিরুদ্ধে চিরন্তন প্রতিবাদ।
ফলশ্রুতিতে ক্রীতদাসের হাসি উপন্যাসটি হয়ে উঠে অন্যায্যতার বিরুদ্ধে মুক্তিকামী বাঙালির প্রতীকী প্রতিবাদের এক অনন্য উদাহরণ।