এলিয়েন বা ভিনগ্রহী জীব বলতে আমরা সেই সব প্রাণী বা জীবের কথা বুঝি, যারা পৃথিবীর বাইরের কোনো গ্রহ, চাঁদ বা মহাজাগতিক অঞ্চলে বসবাস করতে পারে। এই প্রাণীরা আমাদের পৃথিবী জীবনের মতোই কোনোভাবে বা আলাদা ভাবে থাকতে পারে।
এলিয়েন বা ভিনগ্রহী জীব থাকার যুক্তি
মহাবিশ্বে রয়েছে কোটি কোটি গ্যালাক্সি। শুধু আমাদের গ্যালাক্সিতেই প্রায় ১০ হাজার থেকে ৪০ হাজার কোটি নক্ষত্র রয়েছে, যার মধ্যে আমাদের সূর্যও একটি। বিশাল এ মহাবিশ্বে সূর্যের মতো আরো অনেক নক্ষত্র আছে, এবং তাদের মধ্যে কোনটিতে আমাদের সৌরব্যবস্থার মতো ব্যবস্থা থাকতে পারে, যেখানে প্রাণী থাকতে পারে। তাছাড়া এরইমাঝে আবিষ্কৃত হয়েছে পৃথিবীসদৃশ অনেক গ্রহ। তাই বিজ্ঞানীরা যৌক্তিকভাবেই ভাবছেন, পৃথিবীর বাইরের অন্যান্য যেকোনো স্থানেই পৃথিবীর মতো প্রাণের অস্তিত্ব থাকতে পারে।
প্রাচীন অনেক গ্রন্থে অনেকে দাবি করেছেন ভিনগ্রহের প্রাণীরা পৃথিবীতে এসেছিল এবং তাদের দেখা গেছে; তাই সম্ভবত পৃথিবীর আদি বাসিন্দারাও তাদের দেখেছেন। অনেকে পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে UFO (Un-identified Flying Object) নামক অচেনা উড়ন্ত বস্তু দেখার কথাও বলেন। ফলে ভিনগ্রহের প্রাণীর অস্তিত্বের প্রমাণ সংগ্রহে গবেষকরা ঐতিহাসিক উৎসের দিকে মনোযোগ দিচ্ছেন।
বিশিষ্ট বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং এবং কার্ল সেগান এর মতে পৃথিবীর বাইরে মহাবিশ্বের কোথাও প্রাণ থাকার সম্ভাবনা অনেক বেশি। ২০২৩ সালে ‘মহাকাশে এলিয়েনের অস্তিত্ব আছে নাকি নেই’- এ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা দীর্ঘ ১ বছর ধরে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও গবেষণার পর ৩৬ পৃষ্ঠার এক রিপোর্ট প্রকাশ করে। কিন্তু ঐ প্রতিবেদনে খুব একটা সন্তোষজনক কিছু মিলেনি। সে রিপোর্টে বলা হয়নি যে বহির্জাগতিক কোন বুদ্ধিমান প্রাণীর অস্তিত্ব আছে, আবার ব্যাপারটা তারা অস্বীকারও করেনি। তবে নাসার প্রশাসক বিল নেলসন স্বীকার করেন বিলিয়ন বিলিয়ন গ্রহ-নক্ষত্রের মধ্যে পৃথিবীর মতো আরেকটা গ্রহ থাকতে পারে। তার বক্তব্য ছিল, “আপনি যদি আমাকে ব্যক্তিগতভাবে জিজ্ঞেস করেন যে এই বিশাল সৌরজগতে অন্য প্রাণের অস্তিত্ব আছে কি- না আমি বলবো, হ্যাঁ।”
এলিয়েন বা ভিনগ্রহী জীব থাকা সম্ভব যে কারণে
এলিয়েনের অস্তিত্বের সম্ভাবনা সম্পর্কিত শক্ত কারণ হলো আমাদের পৃথিবীতে ‘এক্সট্রিমোফিলস’ নামের বিশেষ ধরনের জীবের উপস্থিতি। এই জীবগুলো এমন কঠোর পরিবেশে বেঁচে থাকে যেখানে সাধারণ জীবদের বাঁচা সম্ভব না। উদাহরণস্বরূপ, আর্জেন্টিনার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের সাগরপৃষ্ঠ থেকে ৪,৭০০ মিটার (১৫,৪০০ ফুট) উচ্চতায় অবস্থিত ডায়মান্ট হ্রদে এই ধরণের ‘পলিএক্সট্রিমোফিলস’ নামে একটি ব্যাকটেরিয়া পাওয়া গেছে। মাইপো আগ্নেয়গিরির নিকটে অবস্থিত এই হ্রদে অক্সিজেনের প্রচুর অভাব সত্ত্বেও কোটি কোটি ব্যাকটেরিয়া বেঁচে রয়েছে। হ্রদের অস্বাভাবিক অ্যাসিডিক পরিবেশে আর্সেনিকের মাত্রা নিরাপদ পরিমাণের ২০ হাজার গুণ বেশি এবং তাপমাত্রা প্রায়ই শূণ্যের নিচে থাকে, তবে অতিরিক্ত লবণাক্ততার জন্য এই হ্রদের পানি বরফে জমাট বাঁধেনা। এই ধরনের পরিবেশে কোন জীবনের বেঁচে থাকার সম্ভাব নয়, কিন্তু বিজ্ঞানীরা এখানে ‘পলিএক্সট্রিমোফিলস’-এর অস্তিত্ব খুঁজে পেয়েছেন। এই আবিষ্কার ভিনগ্রহের বৈরি পরিবেশে প্রাণের সম্ভাবনার পক্ষে একটি শক্তিশালী যুক্তি প্রদান করে। তাছাড়া ‘টারডিগ্রেইড’ নামক একটি জীব পৃথিবীর অনেক জায়গায় পাওয়া যায়। তারা বায়ুর অভাব, চরম তাপমাত্রা, লাভা, এমনকি মহাশূন্যেও জীবিত থাকতে পারে।

এ কারণে, মহাকাশে পানি বা আমাদের মত পৃথিবীর পরিবেশ না থাকলেও সেখানে প্রাণের অস্তিত্ব থাকা সম্ভব, হয়তো তা এককোষী হবে এবং আমাদের মতো বুদ্ধিমান হবে না। জাপানে বিজ্ঞানীরা ই-কোলাই ব্যাকটেরিয়াকে আল্ট্রাসেন্ট্রিফিউজ যন্ত্রে দ্রুত ঘোরানোর মাধ্যমে ৪০০,০০০ গুণের বেশি মাধ্যাকর্ষণ শক্তিতে পরীক্ষা করে দেখেছেন। বিস্ময়করভাবে, এসব ব্যাকটেরিয়া এত চরম মাধ্যাকর্ষণেও সুস্থ ও সক্রিয় ছিল। যেখানে আমরা ৯G -তে অজ্ঞান হয়ে যাই, তারা ৪০০,০০০ G -এ বেঁচে ছিল। তাই, এসব ব্যাকটেরিয়ার মতো জীব মহাকাশের বৈরি পরিবেশে সারা মহাবিশ্বে ছড়িয়ে থাকতে পারে। তাছাড়া বেশ কিছু ধূমকেতু ও উল্কাপিন্ডে জীবনের জন্য অপরিহার্য অ্যামিনো অ্যাসিড পাওয়া গেছে যা জৈব অণূ নিউক্লিয় অ্যাসিড তৈরির প্রধান উপাদান। তাই ধারণা করা হয় যে, পৃথিবীতে প্রাণের জন্য অপরিহার্য জৈব যৌগের আর্বিভাব মহাশূন্য থেকেই এসেছে এবং এই কারণে পৃথিবীর বাইরে যে প্রাণের সঞ্চার থাকবে তার সম্ভাবনা রয়েই যায়।
এলিয়েন থাকলে তা দেখতে কেমন হতে পারে
সিনেমাতে আমরা এলিয়েনদের যেভাবে দেখে অভ্যস্ত সেভাবে হয়তো এলিয়েনদের দেখা পাওয়া যাবে না তবে এলিয়েনদের অস্তিত্ব থাকাটা অসম্ভব কিছু নয়। বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব মতে এলিয়েনদের রূপ ভিন্ন রকমের হতে পারে। এটি সম্পূর্ণভাবে তাদের জীবনধারণের পরিবেশের উপর নির্ভর করবে। পৃথিবীর জীবনের তুলনায় এলিয়েনরা হয়তো আমাদের কাছে অচেনা বা ভিন্ন চেহারার হতে পারে। সাধারণ কিছু অনুমান এমন হতে পারে-
১. মাইক্রোস্কোপিক জীবাণু: অনেক বিজ্ঞানী মনে করেন, এলিয়েনরা হয়তো পৃথিবী মতো বুদ্ধিমান নাও হতে পারে, তবে মাইক্রোস্কোপিক জীবাণু হিসেবে অন্য গ্রহে থাকতে পারে।
