ঈশপের গল্পের কথা বললে প্রথমেই আমাদের ছোটবেলায় দাদী, নানী বা মায়ের কোলে শুয়ে গল্প শোনার কথা মনে পড়ে যায়। ঈশপের অন্তত একটা গল্প কেউ পড়েনি বা শােনেনি এমন মানুষ বােধ হয় পৃথিবীতে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। এমনকি দেখা যাবে আমাদের অনেকেরই গল্পের বই পড়ার সূচনা হয়েছে ঈশপের গল্প দিয়ে। কচ্ছপ ও খরগোশের গল্প, মিথ্যেবাদী রাখাল, তৃষ্ণার্ত কাক, রাজহাঁস ও সোনার ডিম, শেয়াল ও বকের গল্প… আমাদের ছেলেবেলাকে রঙিয়ে দেয়া এই চমৎকার সব গল্পের স্রষ্টা ঈশপ। তার নাম আমরা অনেকে শুনে থাকলেও তার সম্পর্কে বিশদ বলতে গেলে আমরা প্রায় কিছুই জানিনা।
আড়াই হাজার বছর আগের এই সাবলীল ও উপদেশমূলক চমৎকার গল্পগুলাের জনপ্রিয়তা পৃথিবীর মানুষের কাছে কমে তো নয়ই বরং ক্রমশ বেড়ে চলেছে। এই লেখায় আমরা ঈশপ ও ঈশপের গল্প সম্পর্কে বিস্তারিত জানার চেষ্টা করবো।
ঈশপের গল্পের বৈশিষ্ট্য
ঈশপের প্রতিটি গল্প অত্যন্ত সহজ ভাষায় বর্ণিত। তার গল্পের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে গল্পের চরিত্রগুলো বিভিন্ন জীব, জন্তু ও প্রাণীদের নিয়ে তৈরি। তার গল্পের নায়ক বা নায়িকাদের অধিকাংশই ইতর প্রাণী বিশেষ । বিশেষ করে বনের বাঘ, ভাল্লুক, শিয়াল, কুকুর , হরিণ, হায়েনা, কাক, বক, ঈগল, বিড়াল, বানর, পিঁপড়া, ঘাস ফড়িং ইত্যাদি তার গল্পের চরিত্র সমূহের মধ্যে অন্যতম। এরা মানুষের মতাে কথা বলতো এবং আজও বলে চলে।
তার গল্পের দ্বিতীয় প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে গল্পের শেষে সুন্দর একটি শিক্ষণীয় উপদেশ বাণী। এইসব চমৎকার আদর্শিক চিরন্তন ও শাশ্বত উপদেশমূলক বাণীসমূহ সর্বকালে পৃথিবীর সব দেশের মানুষের জন্য প্রযােজ্য। আসলে এইসব আদর্শের কথাটা ও উপদেশ বাণীটা শােনাবার জন্যই ঈশপ গল্পের আবরণে তা রাঙিয়ে সুন্দর করে পরিবেশন করতেন। যাতে মানুষ বিরক্ত না হয়। মূলত: এই মৌলিক বিশেষত্ব-ই তাকে কালজয়ী করেছে।
তাছাড়া তার প্রতিটি গল্পে যেন সমাজের বাস্তবতা প্রতিফলিত হয়। সমাজের নানা ভুলগুলো আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়া গল্পের চরিত্রগুলো। আর তার সৃষ্ট গল্পগুলাে এমনই মজার যে তা সব শ্রেণির পাঠকের সমান ভালাে লাগে। এমন কি বিখ্যাত গ্রিক দার্শনিক সক্রেটিসও ছিলেন তার গল্পের ভক্ত।
কিন্তু, কে এই ঈশপ? তাঁর পরিচয় পরিচয় কী?
ঈশপ ছিলেন একজন বিখ্যাত প্রাচীন গ্রীক গদ্যকার। তার জীবন ও কর্ম খুব বেশি জানা না গেলেও এথেন্স -এ তার বাস ছিল।
প্রথম জীবনে ছিলেন একজন সামান্য ক্রীতদাস। দেখতেও ছিলেন নাকি অতি সাধারণ, কুৎসিত এবং কৃষ্ণকায়। আনুমানিক খ্রীষ্টপূর্ব ৬২০ থেকে ৫৬০ অব্দ পর্যন্ত তার সময়কাল ধরা হয়ে থাকে। দেখতে কুৎসিত হলেও বানিয়ে বানিয়ে চমৎকার গল্প বলার এক অসাধরন গুণ ছিলো তার। তিনি বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমে তার শিক্ষাপ্রদ অমর কাহিনীগুলো মানুষকে শোনাতেন। যেগুলো শুনে লােকজন অভিভূত হয়ে যেতাে।
জীবনী
প্রচীন গ্রীকের অধিবাসী হলেও ধারণা কর হয় যে, ঈশপ জন্মগ্রহণ করেছিলেন দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপের থ্রেস অঞ্চলে। যা বর্তমান গ্রিস ও তুরস্কের মধ্যবর্তী অঞ্চলে অবস্থিত। এর বাইরে ফ্রিজিয়া, এথিওপিয়া, সামোস, এথেন্স এবং সার্দিস শহরগুলোও তার জন্মস্থানের দাবী করে থাকে।
জীবনের বিশাল একটি সময় ঈশপ এশিয়া মাইনর উপকূলের নিকটবর্তী সামোস দ্বীপে দাসত্বজীবন কাটিয়েছেন। বিভিন্ন ব্যক্তিকে মনিব মেনে তাদের সেবা করেছেন। প্রথম মনিব ছিলেন জানযুস এবং পরবর্তীতে লোডম্যানের দাসত্বে ছিলেন। দুই মনিবই ঈশপকে বেশ পছন্দ করতেন। এক পর্যায়ে ঈশপের গল্প বলার ভঙ্গি এবং দর্শনে মুগ্ধ হয়ে লোডম্যান তাকে দাসত্ব থেকে মুক্তি দেন।
মুক্ত জীবন পেয়ে ঈশপ বিভিন্ন দেশ বিদেশে ঘুরতে লাগলেন। যেখানেই যান, সেখানেই গল্প বলার আসর জমিয়ে ফেলেন। চারদিক ছড়িয়ে পড়তে লাগলাে ঈশপের সুনাম। মানুষের মুখে মুখে তার নাম। তার নীতিশাস্ত্রগুলো মানুষের মনে আবেগের সঞ্চার করত। এভাবে ঈশপের গল্পের ভক্ত দিন দিন বাড়তে থাকে। দেশ বিদেশে ঘুরতে ঘুরতে ঈশপ একদিন লাইডিয়া নামক একটি নগর রাজ্যে পৌঁছেন। সে রাজ্যের রাজা ছিলেন ক্রোসাস। ততোদিনে রাজার কান পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিল ঈশপের কথা। তাই ঈশপকে দেখার ও তার কথার শুনার কৌতুল রাজার মনে ছিল। তাই ডাক পড়ে ঈশপের।
ঈশপের সাথে কথা বলে মুগ্ধ হয়ে যান রাজা। রাজার মাথায় তখন এক বুদ্ধি খেলে গেল। ভাবলেন, ঈশপকে দিয়ে রাজ্যে নীতিবাক্য ছড়িয়ে দিবেন। লোকের মাঝে সমাজ সচেতনতা গড়ে তোলাটা যে খুব দরকার হয়ে পড়েছিল সেই সময়। ক্রোসাস তখন ঈশপকে নিজের সভাসদ হিসেবে নির্বাচিত করেন। রাজসভায় বিভিন্ন নীতিবাক্যের গল্প বলে রাজাকে বেশ প্রভাবিত করেছিলেন ঈশপ। দিনে দিনে রাজার প্রিয়পাত্র হয়ে উঠলেন তিনি। রাজ্যের বুড়ো থেকে বাচ্চারা ঈশপের কাছে গল্প শোনার জন্য অস্থির হয়ে যেত। কিন্তু সুখের দিন ঈশপের জন্য খুব বেশি দিন স্থায়ী হলো না। রাজ্যের কিছু প্রভাবশালী লোক মনে করতে লাগল ইনিয়ে বিনিয়ে ঈশপ তাদের কুকর্মই রাজার চোখের সামনে তুলে ধরছেন। তাই তারা ফন্দি করে রাজাকে প্রভাবিত করল যেন ঈশপকে ডেলফিতে পাঠানো হয়।
গ্রীসের নগর রাজ্য এই ডেলফিত। সেখানে দেবতা অ্যাপোলোর মন্দির থাকায় ডেলফিবাসীর মধ্যে একটা অহংকার বিরাজ করতো। রাজা ক্রোসাইস ভেবেছিলো ঈশপ স্বর্ণমুদ্রা দেয়ার মাধ্যমে গল্প শুনিয়ে তাদের মধ্যে নৈতিকতা ছড়াতে পারবে। কিন্তু ঈশপ সোনা নিয়ে ডেলফিতে গিয়ে এক বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়লেন। আগে থেকেই গাঁথা ষড়যন্ত্র অনুযায়ী কে কতটা স্বর্ণমুদ্রা নিবে তা বিশাল হট্টগোল বেঁধে যায় ডেলফিতে। এই হট্টগোলকে রাজা ক্রোসাইসের চরম অবমানোনা মনে করে স্বর্ণমুদ্রা বিতরণ না করে ঈশপ ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নেয়। অহংকারী ডেলফিবাসী ঈশপের এ সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারেনি। আর চক্রান্তকারীরাও আরো গভীর নীল-নকশা আঁকে।
ডেলফিবাসী দেবতা এপোলোর মন্দির নিয়ে যেমন গর্ব করতো তেমনি এর প্রতিটি জিনিসকে শ্রদ্ধা করতো। ঈশপের ফেরার সময় ষড়যন্ত্রকারীরা গোপনে এপোলো মন্দিরের একটি সোনার পাত্র ঈশপের থলিতে রেখে দেয়। পরবর্তীতে ঈশপ যখন ডেলফি নগরীর সীমানা পার হচ্ছিল তখন চোর সন্দেহে তার থলে তল্লাশি চালিয়ে সেই সোনার পাত্রটি উদ্ধার করা হয়। দেবতার মন্দিরের পবিত্র দ্রব্য চুরি! এটি ছিল খুবই গুরুতর অভিযোগ। ঈশপকে তখন ধরে নিয়ে যাওয়া হলো মন্দির প্রাঙ্গণে। পবিত্র মন্দিরের জিনিস চুরির অপরাধে তাকে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়।
তারপর বিধান অনুযায়ী ঈশপকে পাহাড় চূড়া থেকে নিক্ষেপ করে হত্যা করা হলো। ধারণা করা হয় ঘটনাটা ছিল খ্রিস্টপূর্ব ৫৬৪ সালের দিকে। এভাবে ঈশপের জীবনের করুণ পরিসমাপ্তি ঘটে।

তবে ঈশপের মৃত্যুর এই মতবাদ নিয়েও অনেক দ্বিমত রয়েছে। বিশেষ করে ইতিহাসবেত্তা অ্যারিস্টটল, হিরোডোটাস ও প্লুটার্ক ঈশপের মৃত্যুর নির্দিষ্ট কারণ উল্লেখ করেনি। তবে অনেক লেখক উপরোক্ত ঘটনাটিকে ঈশপের মৃত্যুর কারণ বলে মনে করেন।
ঈশপের মৃত্যু তার গল্পের জনপ্রিয়তাকে রুখতে পারেনি। গল্পগুলো ছড়িয়ে পড়ল দেশ-দেশান্তরে। দিন দিন গল্পগুলোর জনপ্রিয়তা বাড়তে লাগল। এতবছর পরেও পুরো বিশ্বে ঈশপের গল্প এখনো জনপ্রিয়তার তুঙ্গে। ঈশপ তার কর্মের জন্যে হয়েছেন অমর। ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে তার নাম।